শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১২ পূর্বাহ্ন
রিপোর্ট: শাকিব বিপ্লব //সদ্য অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি নির্বাচন প্রচারণায় মেয়র প্রার্থী হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নানা প্রতিশ্রুতি ও স্পর্শকাতর বেশ কিছু ভূমিকা নগরবাসীর নজর কাড়লেও নির্বাচন-উত্তর তার হাবভাব পাল্টে গেছে বলে মনে করছে অনেকে। তার সাক্ষাৎ পাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে, সেলফোনও ধরেন না। মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই তার এই আচরণগত কারণে কথা উঠেছে- ভবিষ্যতে সাদিক আবদুল্লাহ কোন শ্রেণির মানুষকে মূল্যায়ন করতে চান? নাকি নির্বাচনী বৈতরণী পার পাওয়ায় এখন তিনি নতুন রূপে আবির্ভুত হতে যাচ্ছেন কিনা।
গত দু’দিন ধরে সমস্যা সংশ্লিষ্টতার সমাধান খুঁজতে কালীবাড়ি সড়কে গিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি তার সাক্ষাৎ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানা গেছে। সংক্ষুব্ধ এই ব্যক্তিদের অভিযোগ- তাদের ভেতর থেকে জানানো হয়েছে নেতা কখন উপর থেকে নিচে নামবেন তার কোনো ঠিক নেই, ফিরে যান। সংবাদকর্মীরাও বিশেষ প্রয়োজনে তার সেলফোনে নাড়া দিলেও ইদানিং সাড়া দেননা। অটো কল ডাইভার্ট হয়ে চলে যায় তার ব্যক্তিগত পিএস সুমন সেরনিয়াবাতের কাছে। এই যুবক নিজেও সঠিকভাবে কাউকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারেন না, করেন আমতা আমতা। আবার মেয়রের সাক্ষাৎ লাভের জন্য নতুন এক নিয়ম চালু করা হয়েছে বলে শোনা গেছে। তার বাসভবনের প্রবেশদ্বারে খাতা-কলম নিয়ে বসানো হয়েছে এক তরুণকে। আগন্তুক কাউকে দেখলেই কৈফিয়ত চান, কোথায় যান? নাম-ঠিকানা লেখেন। এরপর নেতার সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করুন। ওই যুবকের ভাষ্য বা কথোপকথনে তার শিক্ষা যোগ্যতার মাপকাঠি অল্পতেই আমলে আনা যায়। ফলে নয়া মেয়রের দেখা পাওয়াতো দূরের কথা তার কাছাকাছি যেতে গেলে এখন ডিঙাতে হয় কয়েকটি দুয়ার। তাই ক্ষুব্ধদের আফসোস- এখনই এই অবস্থা !
বলাবাহুল্য যে, সাদিক আবদুল্লাহ রাজনীতিতে নবাগত হলেও তার কথাবার্তা এবং আচার-আচরণে খুব অল্প সময়েই নিজেকে বরিশাল প্রেক্ষাপটে আলোচনায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাংগঠনিক দূরদর্শীতাও প্রমাণ করে কালীবাড়িমুখী নেতা-কর্মীতের ¯্রােত তৈরীতে দেখিয়েছেন কারিশমা। আবার যুব বয়সে এসে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের মেয়র প্রার্থী হিসেবে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে টপকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় তাক লাগিয়ে দেন দখিণার রাজনৈতিক অঙ্গণে। এরপর নির্বাচনে মেয়র হিসেবে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে প্রমাণ করেন নিজের জনপ্রিয়তা। অনুষ্ঠিত ৩০ জুলাইর ওই নির্বাচন নিয়ে যদিও জোর বিতর্ক রয়েছে। সাদিক আবদুল্লাহর এ বিজয়কে বিরোধী পক্ষ বাঁকা চোখে দেখলেও বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। নির্বাচনী প্রচারকালে এই যুবনেতার মর্মস্পর্শী বক্তব্য, নানা উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি সর্বোপরি মূল নগরী ছেড়ে উপকণ্ঠের গ্রাম সাদৃশ্য ওয়ার্ডগুলোতে বেশিমাত্রায় সময় দেওয়ায় সাধারণ ভোটারদের মণিকোঠায় নিজের স্থান করে নেন অনায়াসে। কখনো খালি পায়ে কর্দমক্ত সড়কে, আবার হাটুপানি ডিঙিয়ে নানা শ্রেণির মানুষের দুর্যোগ স্বচোখে দেখে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন যে কোনো সমস্যার সমাধানে তার দুয়ার সবার জন্য খোলা। কথা চালু আছে, যুব বয়সী সাদিক রাজনীতিতে তুখোর না হলেও তার ব্যবহারিক গুণে একটি ‘ক্রেজ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে নির্বাচন নিয়ে সব বিতর্ক ঢাকা পড়ে যায়।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার কালিবাড়ির দুুয়ারে এখন সাধারণ মানুষের পৌছানো নাকি অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো কারো ভাষায়- নেতার সাক্ষাৎ পাওয়া এখন স্বপ্নের মত। নিচে তার কার্যালয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের তিনি সময় দিলেও আগন্তুক সাক্ষাৎ প্রার্থীদের বলা হয় নেতা বাসায় নেই। অথবা অপেক্ষা করুন ঘুমিয়ে আছে। কখন নিচে নামবে তা অনিশ্চিত, সঠিক সময় জানানো সম্ভব নয়।
নবনির্বাচিত মেয়রের সাথে সাক্ষাৎ প্রত্যাশী কালিবাড়ি ফেরত পলাশপুর ও সাগরদীর চার ব্যক্তির সাথে এই প্রতিবেদকের গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় সদর রোডে। একত্রিত হয়ে আসা সকলের কণ্ঠে শোনা গেল ক্ষোভের সুরে নানা কথা। বললেন এবং জানালেন- কালিবাড়ির নানা দৃশ্য ও তিক্ত অভিজ্ঞতা। সত্তর বছরের এক বয়োবৃদ্ধ আফসোসের সুরে বললেন, আজীবন আওয়ামী লীগ করলাম। পেলাম না কিছুই। তবে শওকত হোসেন হিরন মেয়র থাকা অবস্থায় নিজে না কিছু পেলেও নগরীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছে। কখনো কখনো সাক্ষাৎ করতে গেলে সহসায় দেখা করে সমাধানও নিয়ে এসেছেন নানা সমস্যার। তার ভাষায়- সাদিক আবদুল্লাহর মধ্যে হিরন-সাদৃশ্য তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। শুধু কথা নয়, হাটাচলা এবং ব্যবহার সবকিছুতেই আগামী দিনের বরিশালের নেতা হিসেবে তাকেই ভাবা হচ্ছিল। ইতিপূর্বে সাদিক আবদুল্লাহর সাথে তার একদফা সাক্ষাত লাভের সুযোগ মিলেছিল। তখন তাকে সরল এক যুবক হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন। সেই বৃদ্ধর দাবি- মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শোনা গেছে গাড়ি রেখে সাদিক রিকশায় নগরীতে ঘোরেন। কখনো কখনো তার নির্বাচনী প্রচারনা চালাতে গিয়ে দেখে আসা সেই দুঃখি মানুষদের সাথেও দেখা করে এসেছেন। কিন্তু ক’দিন না যেতেই এখন তাকে আর দেখা পাওয়া যায় না কোথাও। হয় থাকেন ঘরে, নয়তো দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ত।
চারজনের মধ্যে এই বৃদ্ধের সমস্যা তার মেয়েকে নিয়ে। অপর তিনজন জমি-জমা নিয়ে উচ্ছেদ হচ্ছেন এমন পরিস্থিতিতে নেতার দরবারে এসেছিলেন বেশ আশা নিয়ে। কিন্তু বাসায় প্রবেশ করা মাত্রই অল্প বয়সী এক যুবক তাদের আসার হেতু জানতে চেয়ে নাম-দস্তখত দিতে বলেন। এতে অবাক হন, ক্ষোভে দাঁড়িয়ে থাকেন কালিবাড়ি সড়কে। দু/একজন পরিচিতজনের সাথে দেখা হওয়ার পর তাদের কাছে আকুতি জানানো হয় নেতার সাথে সাক্ষাতে সুযোগ পাওয়ার। দলীয়ভাবে সাদিক আবদুল্লাহর কাছের লোক এই ব্যক্তিদের দুইজন বেশ কিছুক্ষন পর বাস ভবন থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, নেতা ব্যস্ত আছেন, এখন দেখা করা যাবে না। এসময় সেখানে থাকা দলীয় কয়েকজন কর্মীর ভাষ্য ছিলো- নেতা এখন টুটুল আর গ্যাস্ট্রিক বাবুর সাথে কথা বলেই শেষ করতে পারেন না। অন্যদের সময় দেবে কখন। এ কথা অমূলক নয়। প্রমাণ, তখন তাদেরই সামনে বেশ কয়েকজন ভিআইপি গোছের ব্যবসায়ী এবং দলীয় লোক দেখা করে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে আসেন এবং বলতে থাকেন, নেতা কি বললেন। অথচ ওই চার ব্যক্তি এত কষ্ট করে দুয়ারের সামনে এসেও নেতার ছায়া দেখতে পেলেন না। অগত্যা আর কি, নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়।
একই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এক পত্রিকার তরুণ সম্পাদক। তার অভিযোগ- নেতার সাথে দেখা করতে গেলে আগে সরাসরি রুমে যাওয়া যেত। অর্থাৎ নিচে থাকা তার কার্যালয়ে। এখন সেখানে প্রবেশ করার আগেই এক তরুন খাতা-কলম নিয়ে বসে থাকেন এবং এমন সব প্রশ্ন করেন যা শুনে নেতার সাথে দেখা করার যেন সাধ সেখানেই মিটে যায়। কি কারণে এসেছেন? তা উল্লেখসহ সেলফোন নম্বর দিয়ে অপেক্ষা করার জন্য ওয়েটিং রুমে থাকার পরামর্শ দেওয়ার অঙ্গভঙ্গি দেখে আর মনে চায়নি সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করার। ওই সম্পাদকের আফসোস- তিনি তার পরিচয় দিলে ওই তরুণ বুঝতে পারেননি সম্পাদক শব্দের মানে কি? একপর্যায়ে সাংবাদিক বলার পর প্রতিউত্তরে জানতে চাইলো- কোন পত্রিকার? লজ্জিত ওই সম্পাদক ক্ষুব্ধ হলেন। পরে অবশ্য সরাসরি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে আসেন বলে জানান। এ ঘটনা দু’দিন আগের।
গত রাতের কাহিনী আরো বিস্মিত করে। একজন প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক তার কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনার্থে নবনির্বাচিত মেয়রের সেলফোনে (০১৭১১-৫৩৬৩২২) নক করেন। অনুমান করা গেল- তার ফোন ডাইভার্ট করা হয়েছে একান্ত সহকারী ছাত্রলীগ নেতা সুমন সেরনিয়াবাতের সেলফোনে। এই ছাত্রলীগ নেতা ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষন পর ওই সাংবাদিকের কাছে নিজেই ফোন করে জানতে চান কারণ কি, কাকে খুঁজছেন? নবনির্বাচিত মেয়র সাহেবের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা জানানো হলে প্রতিউত্তরে বলা হয়- তাকেই বিষয়টি জানাতে। তিনি মেয়র মহোদয়ের সাথে কথা বলে উত্তর দেবেন। এরপর কয়েকদফা ফোন করা হলেও আর রিসিভ করেননি। রাত ১২টার কিছু আগে সুমন সেরনিয়াবাত নিজেই পুনরায় ফোন করে ওই সাংবাদিককে জানান- আপনি যে বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন তা নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করুন। কিন্তু বিষয়টি এই দুই নেতার সংশ্লিষ্ট নয়, প্রয়োজন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে। এই মন্তব্য করায় আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন- মেয়র কি আর বলবেন (!) একজন শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা এবং নগরীর মেয়র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের ব্যক্তির পার্সোনাল পিএস যদি তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে আশানুরূপ বক্তব্য দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তাহলে মেয়র কিভাবে জানবেন কোথায় কি ঘটছে এবং যেতে হবে।
নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাদিক আবদুল্লাহ এখন দেখে-শুনে ফোন রিসিভ করেন। বিশেষ করে সচরাচর তার চারপাশে থাকা বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা সেলফোনে কল করলে ঠিকই তিনি সাড়া দেন। অপরিচিতজন অথবা সাংবাদিক হলে তার কল চলে যায় সুমন সেরনিয়াবাতের কাছে। যা রহস্যজনক। বেশ কয়েকদিন ধরে এ ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে কানে আসছিল যে, এখন আর সাদিক আবদুল্লাহর সহসা যেমন সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না, তদ্রুপ সেলফোনেও সাড়া দেয় না। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তার এই আচরণগত পরিবর্তনে নানা শ্রেণির মানুষের মাঝে নেতিবাচক প্রশ্ন জাগ্রত হচ্ছে। হওয়াটাইতো স্বাভাবিক। কারণ আগামীর নেতার দুয়ারে এখনই এত প্রতিবন্ধকতা। তাহলে দিনতো আরো বাকী।
Leave a Reply