রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৫ পূর্বাহ্ন
পিরোজপুর প্রতিনিধি॥ ‘এমন দিনও গেছে, সংসারে অভাবের কারণে মেয়ে না খেয়ে কলেজে ক্লাস করেছে। এখনো সে অভাব সংসারে লেগে আছে। এখন মেয়ের মেডিক্যালে ভর্তি ও পড়ার খরচ কিভাবে চালাব তা ভেবেই পাচ্ছি না। ’ কথাগুলো বলছিলেন জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সাবনূর আক্তারের মা।
সাবনূর পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার দক্ষিণ কামারকাঠি গ্রামের দিনমজুর বাবুল মোল্লা ও সাবিনা বেগমের মেয়ে। সাবনূরের মতো কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বৈরাগীর চর গ্রামের সবুজ আহমেদ। কিন্তু সবুজের মুখে হাসি নেই। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় তাঁরও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মা পারেননি বাল্যবিয়ের কারণে, মেয়ে দেখালেন
সাবনূরের বাবা বাবুল মোল্লা বলেন, ‘আমার এক ছেলে, দুই মেয়ে। আমি দিনমজুর। তার ওপর বছর পাঁচেক ধরে অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত। আগের মতো কাজ করতে পারি না। আমার একার আয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণে কষ্ট হয়। আমার স্ত্রী সংসারে একটু সচ্ছলতায় কাজবাজ করে। আমি তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে ধারদেনায় জর্জরিত।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা সাবনূরকে নিয়ে গর্ব করতেন। সে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। তখন ওকে ভালো প্রাইভেটও দিতে পারিনি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথায় ও সহযোগিতায় উপজেলার শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করাই সাবনূরকে। কলেজের শিক্ষকদের আমাদের অবস্থার কথা খুলে বললে তাঁরা মেয়েকে সহযোগিতা করেন। প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষক ও সহপাঠীরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে।
সাবনূরের মা সাবিনা বেগম বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনাকালে বাবা আমাকে বিয়ে দেন। তখন আমার পড়ালেখার খুব ইচ্ছা ছিল। তা পারিনি। সেই থেকে পণ করি, আমার ছেলে-মেয়ে হলে তাদের ইচ্ছানুযায়ী পড়াশোনার সুযোগ দেব। সংসারে অভাবের কারণে আমি মানুষের বাড়িতে মাঝে মাঝে কাজ করি। রাতভর ঘরে বসে পাটি ও হাতপাখা বুনি। অভাবের কারণে মেয়েকে কলেজে যাওয়া-আসার ভাড়াও দিতে পারিনি। মেয়ে বাসা থেকে আট কিলোমিটার পথ হেঁটে কলেজে যাতায়াত করত। এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পায়। ওর রেজাল্ট দেখে মাহমুদ স্যার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেন। এতে তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। এখন মেয়ের ভর্তি ও পড়ার খরচ কিভাবে চালাব!
গতকাল সোমবার বাড়িতে গেলে সাবনূর বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত আসতে শিক্ষক ও সহপাঠীদের অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা পেয়েছি। আমি মেডিক্যালে চান্স পেয়ে এখন ভর্তির জন্য দুশ্চিন্তায় আছি। মা-বাবার মন খারাপ। যদি মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারি, ডাক্তার হয়ে আমি মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করব। ’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোসারেফ হোসেন বলেন, ‘আমি তাঁদের আমার অফিসে আসতে বলেছি। ঘটনা শুনে সাবনূরের মেডিক্যালে ভর্তিতে যা খরচ হয়, তা আমরা বহনের চেষ্টা করব।
সবুজের কপালে চিন্তার ভাঁজ
সবুজ আহমেদ দৌলতপুর উপজেলার বৈরাগীর চর গ্রামের নতুন চর স্কুলপাড়ার সবজি ব্রিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক সর্দারের ছেলে। তাঁরা এক বোন, ছয় ভাই। সবুজ পঞ্চম। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহী সবুজ পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় (বিজ্ঞান বিভাগ) জিপিএ ৫ পায়। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির লিখিত পরীক্ষায় সে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭৪ পেয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০০ নম্বরের মধ্যে তার প্রাপ্ত নম্বর ২৭৪।
সবুজের বাবা আব্দুর রাজ্জাক সর্দার বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। খুব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আমার ছেলে বড় হয়েছে। কখনো খাবার জুটেছে, কখনো জোটেনি। আমি শাক-সবজির ব্যবসা করি। দুরবস্থার মধ্যেও সন্তানের পড়ালেখায় উৎসাহ দিয়েছি। নদীভাঙনে আমাদের সব জমি বিলীন হয়ে গেছে। শুধু বাড়ির জমিটা আছে। আমার ছেলে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে। কিন্তু আমি চিন্তা করে কূল পাচ্ছি না, কিভাবে ছেলেকে ভর্তি করাব; বই কিনে দেব, খরচ চালাব। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আপনারা সবাই আমার ছেলের জন্য সাহায্য করুন।
তিনি বলেন, ‘খুব কষ্ট করে ছেলেদের বড় করেছি। বড় ছেলেটা এমএ পাস, মেজোটা বিএ পাস। পরের ছেলেটা ইন্টার পাস। ছোট ছেলেটা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
সবুজের মা মনজুরা খাতুন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমাদের স্বপ্ন ছিল, ছেলেটা ডাক্তার হবে। এখন ছেলে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ছেলের ভর্তির টেনশনে ঘুম হয় না।
গ্রামবাসী জানায়, বৈরাগীর চর ও আশপাশের এলাকায় কোনো ডাক্তার নেই। তারা চায় সবুজের সাহায্যে সবাই এগিয়ে আসুক।
বৈরাগীর চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সবুজ গরিব হওয়ায় স্কুলের বেতন ফ্রি করে দিয়েছিলাম। অন্য শিক্ষকরা তাকে সাহায্য করেছেন। কেউ প্রাইভেট পড়ানোর টাকা নিতেন না। সৌজন্য সংখ্যার বইগুলো সবুজকে দিতাম। এখন তার পড়াশোনার জন্য সবার সহযোগিতা চাচ্ছি।
সবুজ আহমেদ বলেন, ‘পরিবার, প্রতিবেশী ও শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতায় আমি মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় সফল হয়েছি। কিন্তু আমার ভর্তি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
দৌলতপুরের ইউএনও আব্দুল জব্বার বলেন, ‘অসচ্ছলতার কথা তারা আমাদের জানালে সরকার থেকে সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে। ওই ছাত্রের পড়ালেখার দায়িত্ব সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হবে।
Leave a Reply