বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:২৪ অপরাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন॥ ক্লিনিক্যাল ও নাগরিক বর্জ্যে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন বরিশাল নগরবাসী। দুটি সরকারি হাসপাতালের বর্জ্য মাটি চাপা এবং বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে।
এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে নাগরিক বর্জ্যও। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশের ওপরও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। সব মিলিয়ে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন নগরীর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ।
গর্ত করে ফেলে রাখা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের বর্জ্য : কাগজে-কলমে ১১শ’ শয্যা থাকলেও বাস্তবে ইনডোর-আউটডোর মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার মানুষ চিকিৎসা নেন নগরীর দুটি সরকারি হাসপাতালে। এরসঙ্গে শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে (শেবাচিম) নতুন ১৫০টি করোনা বেড যুক্ত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসায় প্রতিদিন কয়েক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো সঠিক পদ্ধতি নেই। শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, করোনা ওয়ার্ডের বর্জ্য তাৎক্ষণিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
এছাড়া হাসপাতাল কম্পাউন্ডে গর্ত করে অন্যসব ক্লিনিক্যাল বর্জ্য পুঁতে ফেলা হয়। তার দাবি অনুযায়ী, প্রতিদিন বর্জ্য ফেলার পর ব্লিচিং পাউডার ও সোডা দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়। কিন্তু সরেজমিন গিয়ে গর্তে বর্জ্য দেখা গেলেও ব্লিচিং পাউডার কিংবা সোডা দেয়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি। সেখানে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই পড়ে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ে।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. দেলোয়ার হোসেন জানান, গর্ত করে সব ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ফেলা হয়। এ দুই কর্মকর্তার অভিযোগ, সাড়ে ৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালের বর্জ্য নিচ্ছে না সিটি কর্পোরেশন। ফলে তা ফেলতে হচ্ছে গর্ত করে। সিটি কর্পোরেশনের কনজার্ভেন্সি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, নিয়মানুযায়ী হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকার কথা। মেডিকেল বর্জ্যরে মতো ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য নেয়ার বিধান আমাদের নেই। এছাড়া আমরা ওই বর্জ্য নিয়ে ফেলব কোথায়? যেখানেই ফেলব সেখানেই তো ঝুঁকির মুখে পড়বে মানুষ।
উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য : বরিশাল নগরীতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে দুই শতাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলোর বর্জ্য নগরীর কাউনিয়া এলাকার উন্মুক্ত ডাম্পিং জোনে ফেলা হচ্ছে। ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী জমাদ্দার বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা কিছু এনজিওর ওপর নির্ভর করি।
সেবা কেন্দ্রে লাল, হলুদ ও সবুজ রংয়ের ঝুড়িতে বর্জ্য ফেলা হয়। চুক্তিভিত্তিক এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় কিছু এনজিও। এসব এনজিও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সেগুলো নষ্ট করে। এজন্য তাদের মাসিক ভিত্তিতে আমরা টাকা দেই। আরিফ মেমোরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নষ্ট করার কথা থাকলেও এনজিওগুলো তা করে না। আমি নিজে ডাম্পিং জোনে গিয়ে দেখেছি উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য।
আগে এনজিওগুলো চুল্লিতে বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলত। সেই চুল্লি এখন নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা এনজিওগুলোর একটি প্রদীপন। এর কর্মকর্তা রনজিত কুমার দত্ত বলেন, উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলার অভিযোগ সত্য নয়। এটা ঠিক যে ঝড়ে চিমনি ভেঙে যাওয়ায় নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয় না। আমাদের কর্মীরা ডাম্পিং জোনে গর্ত করে বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলেন।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই : শুধু সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক নয়, খোদ নগর ভবনেরও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ক্লিনিক্যাল বর্জ্যরে পাশাপাশি পাঁচ লাখ নগরবাসীর বর্জ্য শুধু ডাম্পিং জোনে ফেলা হয়। কর্পোরেশনের কনজার্ভেন্সি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা একটি ইনসিনেরেটর সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে করোনা পরিস্থিতির কারনে কার্যক্রম খানিকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।
বরিশালের পরিবেশ ফেলো মুরাদ আহম্মেদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে শুধু বর্জ্য তুলে এনে ফেলা রাখা নয়। নিয়মানুযায়ী সব পুড়িয়ে ফেলতে হয়। প্রথমে বর্জ্যকে তিন ভাগে ভাগ করতে হয়। সংক্রামক বা অতি বিপজ্জনক, সাধারণ বিপজ্জনক এবং সাধারণ বর্জ্য।
এরপর ক্যাটাগরি অনুযায়ী সেগুলোক নিয়ম ও সময় মেনে ইনসিনেরেটরে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু বরিশালে একটিও ইনসিনেরেটর নেই। পুড়িয়ে না ফেলায় নগরীর কাউনিয়া এলাকায় থাকা বর্তমান ডাম্পিং জোনের আশপাশের বাসিন্দারা এখন বসবাস করছেন ঝুঁকির মধ্যে। শ্বাসকষ্টসহ চর্ম ও পেটের নানা পীড়ায় তারা ভুগছেন। বরিশালে ইটিপি কিংবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্য কোনো উপকরণও নেই। অথচ নিয়ম মেনে সঠিক পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা গেলে এসব সমস্যা হতো না।
১০ বছর ধরে বিকল ইনসিনেরেটর : ২০০৩ সালে সদর হাসপাতালের জন্য একটি ইনসিনেরেটর বরাদ্দ হয়। নগরীর একেবারে কেন্দ্রে হওয়ায় সেখানে এটি বসাতে আপত্তি তোলে পরিবেশ অধিদফতর। বহু চিঠি চালাচালির পর ২০০৯ সালে শেবাচিম হাসপাতালে তা বসানো হয়। হাসপাতালের পরিচালক ডা. বাকির হোসেন বলেন, ‘ঘণ্টায় ২৫ লিটার কেরোসিন লাগত সেটি চালাতে। বর্জ্য পোড়ানো যেত ২০ থেকে ৩০ কেজি।
কিন্তু শেবাচিম হাপাতালের বর্জ্য দৈনিক কয়েক টন হওয়ায় মেশিনটি কাজে আসছিল না। এছাড়া কেরোসিনের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে ঢাকা। ফলে সেটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় তৎকালীন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ থাকতে থাকতে এক সময় সেটি নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, বহু বছর ধরে ইনসিনেরেটর এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যন্ত্র চেয়ে আসছি। কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মান্ধাতা আমলের ইনসিনেরেটর হওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। অথচ প্রায় ২ কোটি টাকায় সেটি কেনা হয়েছিল। ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল বলেন, সরকারি উদ্যোগে ইনসিনেরেটর পেতে ব্যর্থ হয়ে আমরা বেসরকারিভাবে ইনসিনেরেটর বসানোর অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়সহ বহু বিভাগে ৩ বছর ধরে দৌড়ঝাঁপ করছি।
কিন্তু অনুমতি মেলেনি। স্থানীয় পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বেসরকারি সংস্থা ‘এইড’র পরিচালক মুনির হোসেন বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে আমরা ইটিপি কিংবা ইনসিনেরেটর বসিয়ে কাজটি করতে পারতাম। কিন্তু বছরের পর বছর চেষ্টা করেও তা পাইনি।
বরিশালের স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ডা. বাসুদেব বলেন, বিষয়টি নিয়ে বহুবার বৈঠকে বসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কমিটির সদস্য সচিব পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালককে কখনও মিটিংয়ে পাওয়া যায়নি। ফলে খুব একটা কিছু করতে পারিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক আবদুল হালিমের মোবাইল নম্বরে ফোন দেয়া হলেও তিনি তা ধরেননি। তার নম্বরে পাঠানো খুদেবার্তারও তিনি উত্তর দেননি।
Leave a Reply