রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন
পিরোজপুর প্রতিনিধি॥ খুশির বন্যা বইছে বলেশ্বর নদের দুই পাড়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে দুই উপজেলার মানুষের। ফেরি চলে এসেছে। এখন চলাচল শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মাছুয়া এবং বাগেরহাটের শরণখোলার রায়েন্দা ঘাটে সম্পন্ন হয়েছে পন্টুন স্থাপনের কাজ। মাছুয়া ঘাটের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। রায়েন্দা ঘাটের সংযোগ সড়কের কাজও শেষ হয়েছে। বাগেরহাট এবং পিরোজপুর জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) বাস্তবায়ন করছে এই কাজ।
আগামী কাল বুধবার (১০ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকবাবে ফেরি চলাচল শুরু হবে। পিরোজপুর-৩ আসনের সংসদ সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজাী এবং বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলশ মিলন ফেরি চলালের উদ্বোধন করবেন। সেই লক্ষ্যে বলেশ্বরের দুই পাড়ে এখন সাজ সাজ অবস্থা বিরাজ করছে।
বলেশ্বরের দুই পারের মাছুয়া এবং রায়েন্দা খেয়া ঘাট জুলুমের ঘাট হিসেবে পরিচিত। আড়াই কিলোমিটার এই নদটি পার হতে একজন যাত্রীকে ৫০০ টাকাও দিতে হয়েছে কোনো এক সময়। হাতে বহনযোগ্য ব্যাগ এমনকি হাঁস-মুরগিরও টোল দিতে হয়েছে ঘাটে। পান থেকে চুন খসলেই ইজারাদারদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বহু মানুষ। নিয়মিত যাত্রীভাড়া ছিল দেড় শ থেকে দুই শ টাকা। তবে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বর্তমানে সেই খেয়া ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার শেষ খেয়ার পর আর পারাপারের সুযোগ নেই। ফেরি চরাচল শুরু হলে যুগ-যুগান্তরের সেই দুর্ভোগ আর জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাবে দুই পারের যাত্রীরা। বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই খেয়া চলছে বলেশ্বর নদে। তখন ইজারা পদ্ধতি চালু ছিল না। দু-চারআনা খেয়া ভাড়া দিয়েই পারাপার হতো দুই পারের মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দুই পারের ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করতো এই ঘাট। এক-দুই হাজার টাকা ইজারামূল্য ছিল তখন। পরবর্তীতে বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলার আওতায় চলে যায় ইজারা। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগের অধীনে ছিল বরিশাল জেলা এবং এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ। তখন নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেওয়া হতো। ১৯৯৩ সালে বরিশাল জেলা বিভাগে উন্নীত হয়। প্রথমদিকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে ঘাটের ইজারা দেওয়া হতো। বর্তমানে দুই বিভাগ যৌথভাবে ইজারা নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেশ স্বাধীনের পর ২০-২৫ বছর পর্যন্ত শান্তি বিরাজ করছিল দুই পারের ঘাটে। কিন্তু পরবর্তীতে ইজারা নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হলে বাড়তে থাকে জুলুমও। এর পর থেকে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতার কোপানলে পড়ে এক-দুই হাজার টাকা থেকে শুরু হওয়া সেই ঘাটের ইজারামূল্য বর্তামানে দাঁড়িয়েছে ৬৫ লাখ টাকায়। আর এর সমস্ত প্রভাব পড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ওপর। শরণখোলাবাসীর পুর্ব পুরুষের বাড়ি বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরগুনা জেলায়। বলেশ্বর দুই পারের মানুষের নাড়ির টান শত বছরের। যে কারণে ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে পার হয় খেয়ার নৌকা। সেই জুলুমের ঘাটে ফেরি আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মঠবাড়িয়া ও শরণখোলাবাসী।
সম্ভাবনাময় বলেশ্বরের ফেরি :
বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হলে উপকূলীয় এই অঞ্চলে সূচনা হবে এক নতুন দিগন্তের। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে অবহেলিত এই জনপদে। ফেরি চলাচলের ফলে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে খুলনার সঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ পরিবহনের তৈরি হবে নতুন ট্রানজিট। যশোর-খুলনা হয়ে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত। পর্যটন শিল্পের আরো উন্নয়ন ঘটবে। মোংলা বন্দরের সঙ্গে পায়রা বন্দরের সহজ যোগসূত্র গড়ে উঠবে। কমে আসবে ৯০ কিলোমিটার পথ। সময় সাশ্রয় হবে প্রায় দুই ঘণ্টা। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে অবহেলিত শরণখোলার শিক্ষার্থীরা।
পেছনে যাদের অবদান :
স্বাধীনতার পর থেকেই প্রমত্তা বলেশ্বর নদে ফেরির দাবি জানিয়ে আসছে দুই পাড়ের মানুষ। দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বাগেরহাট-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন (প্রয়াত) ২০১৮ সালের ১৭ জুন ফেরির দাবিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ে ডিও লেটার (চাহিদা পত্র) প্রদান করেন। একই সময়ে মঠবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আরো একটি ডিও লেটার দেন। এই দুই সাংসদের ডিও লেটারের আলোকে মঠবাড়িয়ার আরেক কৃতি সন্তান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বউদ্যোগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বরাবরে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। তার তৎপরতায় ফেরি বাস্তবায়নের বিষয়টি আরো তরান্বিত হয়। সর্বশেষ বাগেরহাট-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলনের প্রচেষ্টায় আলোর মুখ দেখে দুই উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।
উচ্ছ্বসিত বলেশ্বরের দুই পারের মানুষ :
শিগগিরই ফেরি চালু হবে এই প্রত্যাশায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে সবাই। প্রতিদিন ফেরিঘাটে ভিড় করছে শত শত উৎসুক মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু সববয়সী মানুষের আগমনে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি হয়েছে ফেরিঘাটকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন বিকেল হলেই শত শত লোক আসেন ফেরিঘাট দর্শনে। ঘাটের দুই পাশে নতুন নতুন ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
রায়েন্দা ঘাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. নজরুল ইসলাম মীর জানান, ফেরি ঘাট হওয়ায় লোকজনরে সমাগম বেড়েছে। বেচাবিক্রিও এখন অনেক বেশি হচ্ছে। আবুল হোসেন রায়েন্দা বাজারের ঝাড়ূদার ছিলেন। ফেরিঘাটের সংযোগ সড়কের পাশেই তার ছোট্ট বসত ঘর। তিনি ঝাড়ূদারি বাদ দিয়ে তার সেই বসত ঘরের সামনে চা-পান-সিগারেটের দোকান দিয়েছেন।
ফেরিঘাট সংলগ্ন বলেশ্বর পারের বাসিন্দা যুদ্ধকালীন স্টুডেন্ট ক্যাম্প কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বাদশা বলেন, আমাদের দুই উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে। ফেরিটি চালু হলে সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের একটা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।
রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতাও :
বলেশ্বর নদ থেকে একসময় বড় বড় জাহার চলাচল করতো। রায়েন্দা ঘাটে ভিড়তো ঢাকা, খুলনাগামী যাত্রীবাহী দুইতলাবিশিষ্ট লঞ্চ। এখনো মাছুয়া ঘাটে ভেড়ে স্টিমার। তবে, নদের মাঝখানসহ বিভিন্ন অংশে রয়েছে অসংখ্য ডুবোচর। ভাটির সময় আড়াআড়ি কোনো ভারী নৌযান চলতে পারে না। ডুবোচরে আটকে যায়। জোয়ারের অপেক্ষায় থাকতে হয় তখন। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত বলেশ্বর নদের নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং হয়নি। ড্রেজিং করে ডুবোচর অপসারণ করা হলে আবার যৌবন ফিরে পাবে বলেশ্বর। এ ছাড়া মাছুয়া ঘাট থেকে মঠবাড়িয়া উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। সংযোগ সড়কের ১০০ মিটার পর থেকে বাকি সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। অপ্রস্বস্ত এবং ভাঙাচোরা। তিন-চারটি গার্ডার ব্রিজের অবস্থাও খুবই দুর্বল। ফেরি চলাচল শুরু হলে এই সড়ক থেকে ভারী যানবাহন চলতে গিয়ে পড়তে হবে দুর্ভোগে। তাই এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানায় দুই পারের মানুষ।
বাগেরহাটের সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ১০ নভেম্বর ফেরি উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রায়েন্দা অংশের সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষে পথে। বলেশ্বরের এই ফেরির কারণে পায়রা থেকে মোংরা সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার কমে আসবে। ফেরির সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে পিরোজপুর সড়ক বিভাগ।
বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে যোগাযোগ উন্নয়ণে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এক রোল মডেল। তারই ধারবাহিকতায় এই বলেশ্বর নদের ফেরি সড়ক যোগাযোগে আরেক এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। বলেশ্বর নদের ফেরি চালু হওয়ায় খুলনার সঙ্গে বরিশাল বিভাগ এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের মধ্যে তৈরি হবে এক সেতুবন্ধন। এই ফেরি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্ননেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Leave a Reply