বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৯ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ কুয়েত সাগরের পানি শুকিয়ে যাবে; কিন্তু আমার টাকা শেষ হবে না। কুয়েতে ৩০ বছরে কাচের পাহাড় তৈরি করিনি যে ভেঙে যাবে। আমি পাথরের পাহাড় তৈরি করেছি, যা কোনোদিন ভাঙবে না। এর আগে দেশের মাটিতে বসে বিদেশে পাঠানো শ্রমিকদের সামনে এমন দম্ভোক্তিই করেছিলেন অর্থ পাচার ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল।
পাপুলকে নিয়ে কুয়েত ও বাংলাদেশে আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক এই সময়ে তার বিরুদ্ধে প্রথম মানবপাচারের মামলার এজাহারে এই বয়ান দেন বাদী আবদুল আলীম (৪৩)। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন তিনি। তবে পাপুলের অপকর্মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছিল কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশের সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে এতদিন তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হলেও প্রথমবার মতিঝিল থানায় মামলা হয়েছে। ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলাটি করেন নওগাঁ সদর থানার জব্বার মণ্ডলের ছেলে আবদুল আলীম। মামলা নং-৭। পরস্পর যোগসাজশে সংঘবদ্ধভাবে বিভিন্ন ধরনের প্ররোচনা দিয়ে মানব পাচারের অভিযোগে পাপুল ও তার ৩ সহযোগীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিআইজি (সিরিয়াস ক্রাইম) ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি জানান, মামলায় পাপুল ছাড়াও আরও ৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মতিঝিল থানায় করা মামলাটি সিআইডি তদন্ত করবে।
মামলায় ভুক্তভোগী আরো ৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হলো- ময়মনসিংহের ভালুকা থানার মো. আমীর উদ্দিনের ছেলে মো. শাহ আলম (৩২), জামালপুরের মাদারগঞ্জের মো. আবদুস সামাদের ছেলে আপেল আহম্মেদ (৩২), রাজশাহীর চারঘাটের মো. কাজীমুদ্দিনের ছেলে মো. রুবেল হক (২২) এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর মৃত জোহার আলীর ছেলে মো. সোহাগ (৪০)।
কুয়েত নেয়ার বিনিময়ে এদের প্রত্যেকের সঙ্গে পাপুলের চুক্তি হয়। ৭ লাখ টাকা করে নিয়ে তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে তা দেয়নি পাপুলের কোম্পানি। মামলায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদুল ইসলাম পাপুল (৫৫) ছাড়াও আসামি করা হয়েছে পাপুলের সহযোগী মো. আবদুর রাশেদ (৫৪), মো. রেজাউল করিম (৪৫) এবং মনিরকে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। আবদুল আলীম বলেছেন, আমাদের সঙ্গে কথা ছিল ২ বছর চুক্তিতে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে ডিউটি শেষে মাসিক ১২০ দিনার যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রদান করবে। এর মধ্যে থাকার জায়গা কুয়েতি কোম্পানি ব্যবস্থা করবে, খাওয়া নিজেদের। কিন্তু কুয়েতে যাওয়ার পর তিনি তার কথামতো কাজ না করে ৪ মাস আমাদের বসিয়ে রেখেছেন, কোনো বেতন-ভাতা দেন নাই। পরে কাজ দিলেও প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করে আমাদের মাসে ১০০ দিনার করে বেতন দিত এবং ছুটি দিত না। একদিন কাজে না গেলে আমাদেরকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। এমপি পাপুলের কোম্পানি ‘মারাফি কুয়েতিয়া’-তে প্রায় ২০ হাজারের উপরে বাংলাদেশি লোক কাজ করত। সবাইকেই আমাদের মতো দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে।
মামলার বর্ণনায় বলা হয়েছে, নিদারুণ কষ্টের মুখে একপর্যায়ে কুয়েতের সিআইডি পাপুলের ‘মারাফি কুয়েতিয়া’ কোম্পানিটি অবৈধ ঘোষণা করে। পরে আমি ও আমার সঙ্গীদের কুয়েত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসতে হয়। আমরা বর্তমানে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছি। এমপি পাপুলসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ফকিরেরপুলের ১১৮ ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের ৫ তলা ভবনের ২য় তলায় ছিল তার ট্রাভেল এজেন্সির অফিস। সেখানেই কুয়েত যাওয়া নিয়ে কথা হয়। ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে মনিরের সঙ্গে কুয়েত যাওয়ার জন্য কথাবার্তা বলে ৭ লাখ টাকার মৌখিক চুক্তিতে ২ লাখ টাকা মনিরকে নগদ প্রদান করি।
পরবর্তী ঘটনার বর্ণনায় ভুক্তভোগী বলেন, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে আমিসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও আরও অজ্ঞাতনামা ভিকটিমদের (নাম এই মুহূর্তে মনে নাই পরে দেখলে চিনব) বিভিন্ন সময়ে ওই অফিসে নিয়ে কুয়েতে ভালো বেতনে চাকরি দেবে বলে বিবাদীরা আশ্বস্ত করে। কুয়েত গমনের লক্ষ্যে আমাদেরকে জনপ্রতি ৭ লাখ টাকা করে প্রদানের জন্য আমিসহ অন্য চারজনের সঙ্গে ৩৫ লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। সেই মোতাবেক আমি ২০১৮ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখ বাকি ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে কুয়েতে চলে যাই। এরপর আমার সঙ্গের রুবেল ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর যাওয়ার আগে ৫ লাখ টাকা এমপি পাপুলের অফিসের কর্মচারী মনিরকে দেয়। কুয়েতে গিয়ে বাকি ২ লাখ টাকা পরিশোধ করে। এভাবেই সবাই সাত লাখ টাকা করে দেয়।
প্রসঙ্গত, রাজনীতিতে পোড়খাওয়া প্রবীণ নেতারা এমপি হতে না পারলেও হঠাৎ বিদেশ থেকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেই’ হয়ে গেছেন বাংলাদেশের আইন প্রণেতা বা জাতীয় সংসদ সদস্য। শুধু কী তাই? এই ‘এমপি’র স্ত্রীর শখ পূরণে তাকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদে এনেছেন একই পথে। ‘দলবিহীন’ স্বামী-স্ত্রী এমপি হতে অবশ্য ‘কোটি-কোটি’ টাকা লগ্নি করতে হয়েছে বলে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল। এ হলো লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ও সেলিনা ইসলাম দম্পতির ঘটনা।
Leave a Reply