শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৪৩ পূর্বাহ্ন
খোকন আহম্মেদ হীরা॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কারণে উচ্ছ্বসিত দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশালের মানুষ। বিশেষ করে সড়ক পথকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে সাধারণ মানুষসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এদিকে নৌ-পথের নাব্য সঙ্কটসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নৌরুট।
সড়ক পথের উন্নয়ন হলেও ঢাকা-বরিশাল নৌপথের পাঁচটি স্থানে নাব্য সঙ্কটের কোন স্থায়ী সমাধান করতে না পারায় দিন দিন হুমকির মুখে পড়েছে নৌরুট। এর মধ্যে বরিশাল নৌবন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতে পলি জমে নাব্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয়ে ভোগান্তি বেড়েছে লঞ্চ চলাচলের। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে নৌরুট চরম হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে নৌরুটের জৌলুস ধরে রাখতে বরিশালের লঞ্চ কোম্পানিগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। যাত্রী ধরে রাখার এ প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে তৈরি হচ্ছে আধুনিক লঞ্চ ও স্টিমার।
এ লঞ্চগুলো নির্মিত হচ্ছে বরিশালের ডকইয়ার্ডে। তবে এতকিছুর মধ্যেও সেবার মানে আধুনিকতা আনার অঙ্গীকার থাকা উচিত বলে মনে করছেন সচেতন বরিশালবাসী। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, যাত্রী সেবার মাধ্যমে যাত্রীদের ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে নৌযান মালিকরা। ফলে কীর্তনখোলা নদীর তীরে দেশীয় প্রযুক্তিতে চলছে সুন্দরবন-১৮ লঞ্চের নির্মাণ কাজ। তিনশ’ ফুট লম্বা এবং ৫২ ফুট চওড়া লঞ্চটিতে বিভিন্ন ধরনের কেবিন ছাড়াও যাত্রী সেবায় অনেক কিছুই সংযোজন করা হবে। আগামী বছর ঈদে লঞ্চটি যাত্রীবহনে যুক্ত হবে।
সুরভী-৭ লঞ্চেও নতুন ডেকোরেশনে লিফট লাগানো হয়েছে। কেবিন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই আনা হচ্ছে আধুনিকতা। চলন্ত সিঁড়ি, এটিএম বুথ, হেলিপ্যাড, সুইমিংপুলসহ অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করার চিন্তাভাবনা রয়েছে লঞ্চগুলোতে।
বরিশালের চারটি ডকইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে সুন্দরবন কোম্পানির আটটি, সুরভীর চারটি, কীর্তনখোলা ও এ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির দুটি করে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল লঞ্চ।
এগুলোতে রয়েছে লিফট, আইসিইউ, ডাইনিং, শিশুদের খেলার জোন, রেস্টুরেন্ট, ব্রেস্টফিডিং রুম এবং ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। লঞ্চ চালনায়ও আনা হয়েছে ডিজিটাল যন্ত্র।
নির্মাণাধীন লঞ্চগুলোতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে বলে জানিয়ে লঞ্চ মালিক রেজিন উল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, লঞ্চগুলো অত্যাধুনিক করতে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়; যাত্রীদের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতে সেবার মান বাড়ানো হচ্ছে।
বরিশাল জনস্বার্থ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মানওয়ারুল ইসলাম অলি বলেন, শুধু আধুনিকতার প্রতিযোগিতা না করে সেবার মান বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি যাত্রী ভাড়ার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ নৌপরিবহন (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, সবার আগে যাত্রী সেবার কথা চিন্তা করে আমরা কাজ করছি। সারাবছর যেন নির্বিঘেœ লঞ্চ চলাচল করতে পারে, নাব্য সঙ্কটের কারণে যেন লঞ্চ চলাচল ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।
পাশাপাশি নৌদুর্ঘটনা এড়াতে আমরা রাডারসহ নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছি। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলেও বরিশালের আরাম প্রিয় মানুষ নৌযানে যাত্রা করবেন বলেও আমরা বিশ^াস করছি।
বরিশালের যাত্রীবাহী পরিবহনের চালক-মালিকরা বলেন, পদ্মা সেতু এখন পুরোটাই দৃশ্যমান। আর এর মধ্য দিয়ে সেতুর বেশিরভাগ কাজও শেষ হয়েছে।
এখন যে কাজ তা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলা থেকে ঢাকায় যেতে সময় কমে যাবে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। আর যাত্রীসেবার মানও বাড়বে কয়েকগুণ। তারা আরও বলেন, মাওয়া ফেরি ও সরু সড়কপথের কারণে এ অঞ্চলে বিলাসবহুল পরিবহন সংযোজন যারা এতদিন করতে পারেননি, তারা পদ্মা সেতু চালু হলেই বিনিয়োগ করবেন। আর এ বিনিয়োগকে সফল করে তুলতে এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্প।
সূত্র মতে, দক্ষিণাঞ্চবাসীর রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সহজ যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। রাত্রীকালীন নৌ-ভ্রমণ আরামদায়ক বিধায় নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের পদচারণাও বেশি। কিন্তু চলতি মৌসুমে নাব্য সঙ্কটের কারণে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঢাকা-বরিশাল নৌপথ। এমনকি নাব্য সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সহজ ও নিরাপদ নৌরুটগুলো।
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাসবহুল যাত্রীবাহী লঞ্চ সার্ভিস এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের মাস্টার আলমগীর হোসেন বলেন, ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে বরিশাল নদী বন্দর থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ছয়টি পয়েন্ট নাব্য সঙ্কটের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এসব পয়েন্ট হয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করতে গিয়ে কখনও কখনও দুর্ঘটনার শিকারও হতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নাব্য সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে মিয়ারচর চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এক বছর ধরে ওই চ্যানেল হয়ে লঞ্চ চলাচল করতে পারছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সম্প্রতি মিয়ারচর চ্যানেলের প্রবেশমুখে একটি বাল্কহেড ডুবে যায়।
সেটি উদ্ধার না করায় চ্যানেলটির বিভিন্ন পয়েন্টে পলি মাটি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। এ কারণে বিকল্প চ্যানেল মেঘনার উলানীয়া-কালিগঞ্জ হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে করে গন্তব্যে পৌঁছতে দুই ঘণ্টা সময় বেশি লাগার পাশাপাশি কমপক্ষে তিন ব্যারেল (ছয়শ’ লিটার) জ্বালানি তেল বেশি লাগে। বর্তমানে বিকল্প ওই চ্যানেলটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সূত্র মতে, একসময়ের উত্তাল ওই চ্যানেলটির প্রায় একশ’ মিটার এলাকাজুড়ে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ দুই মিটার পানি থাকছে। অথচ যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো চলাচলের সময় তলদেশ অন্তত দুই মিটার পানিতে ডুবে থাকে। এ কারণে ওই চ্যানেলে মাটি ঘেঁষে লঞ্চ চলাচল করতে হয়। তার মধ্যে ওই চ্যানেলের বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচরে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে থাকায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এ চ্যানেলটিও বন্ধ হয়ে গেলে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের লঞ্চগুলোকে চলাচল করতে হবে ভোলার ইলিশা হয়ে। এতে করে গন্তব্যে পৌঁছতে আরও এক ঘণ্টা সময় বেশি লাগবে। পাশাপাশি জ¦ালানি খরচও বেড়ে যাবে।
অপরদিকে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বাউশিয়া-নলবুনিয়া চ্যানেলে আগে ৭ থেকে ৯ মিটার পর্যন্ত পানি থাকত। বর্তমানে ওই চ্যানেলে জোয়ারের সময় দুই থেকে আড়াই মিটার পর্যন্ত পানি থাকছে। আর ভাটার সময় থাকে মাত্র এক মিটার পানি। যে কারণে ভাটার সময় বড় নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। বাকিটা পলি মাটি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে।
একই অবস্থা বরিশাল শহরের উপকণ্ঠ শায়েস্তাবাদের কীর্তনখোলা ও আড়িয়াল খাঁসহ তিন নদীর মোহনায়। সেখানে পলি মাটি জমে চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন নদীর ওই মোহনায় ভাটার সময় চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই নৌযানগুলো আটকে যাচ্ছে।
অপরদিকে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে নাব্য সঙ্কট সৃষ্টির জন্য বিআইডব্লিউটিএর অপরিকল্পিত ডেজিং ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন লঞ্চ মালিক এবং মাস্টাররা। এর কারণ উল্লেখ করে তারা বলেন, মাত্র একবছর আগে বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগে নদীতে ড্রেজিং করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষ না হতেই যেসব চ্যানেলে ড্রেজিং করা হয়েছে তাতে আবার পলি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে। কেননা ড্রেজিংয়ের বালু যেস্থান থেকে কাটা হচ্ছে তা আবার এক থেকে দেড়শ’ মিটার দূরেই ফেলা হয়েছে। ড্রেজিংয়ের বালু নদীতে না ফেলে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হলে বছর বছর এ সমস্যার সৃষ্টি হতো না।
নাব্যতা সঙ্কটের বিষয়ে বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা এবং বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপরিচালক আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, চলতি মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকে। এ কারণে কিছু কিছু পয়েন্টে পলি জমে নাব্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং ব্যবস্থা চালু করেছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এ সমস্যার সমাধান হবে। তিনি আরও বলেন, যেসব পয়েন্টে পলি জমে নাব্য কমে গেছে সেসব পয়েন্টে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হবে।
আজমল হুদা মিঠু সরকার বলেন, ড্রেজিংয়ের বালু নদীতে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই। কেননা যে পরিমাণ বালু কাটা হয় তা স্থলে ফালানোর মতো জায়গা নেই।
এ কারণে বিগত বছরেও আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম কারোর নিম্নজমি থাকলে তা বিনামূল্যে ড্রেজিংয়ের বালু দিয়ে ভরাট করে দেয়া হবে। এবারও সেই একই ঘোষণা থাকবে। কিন্তু কেউ বালু না নিলে সেক্ষেত্রে নদীতে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে খুব শীঘ্রই ঢাকা-বরিশাল নৌরুট নিরাপদ করে তুলতে চ্যানেলগুলোতে ড্রেজিং কার্যক্রমের মাধ্যমে নাব্য সঙ্কট দূর করা হবে বলেও তিনি (আজমল হুদা মিঠু) উল্লেখ করেন।
Leave a Reply