রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ অপরাহ্ন
বরগুনা প্রতিনিধি॥ করোনাকালে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় ৫০৮৯ জন অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভধারণ করেছেন। এরমধ্যে ১৩,৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। যা দিনে গড়ে ১ দশমিক ৭। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে বরগুণাতে ১৫১২টি, ১২৭২টি কুড়িগ্রামে, নীলফামারিতে ১২২২, লক্ষীপুরে ১০৪১ এবং কুষ্টিয়াতে ৮৮৪টি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে’র ‘বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকাল ২০২০’ শীর্ষক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে। বৃহস্পতিবার এই জরিপ রিপোর্টটি এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। জরিপটি পরিচালনা ও রিপোর্ট তৈরি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সহযোগিতা করেছে ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।
যেসব মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৫০ দশমিক ৬ জনের বিয়ে হয়েছে ১৬-১৭ বছরের মধ্যে। শতকরা ৪৭ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১৩-১৫ এর মধ্যে। শতকরা ১ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১০-১২ বছর বয়সে।
বাল্যবিয়ের উদ্যোগ যারা নিয়েছেন, এরমধ্যে শতকরা ৭৮ জনই বাবা-মা। অথচ শতকরা ৯৬ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ হওয়া উচিৎ। বাল্যবিয়ে নিয়ে সচেতনতা ও চর্চার মধ্যে বড়ধরণের একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে এই জরিপে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৩৭ শতাংশ বলেছেন করোনাকালে তারা তাদের আশেপাশে অন্তত একটি করে বাল্যবিয়ে দেখেছেন। বরগুণার শতকরা ৮৮ ভাগ মানুষ জানিয়েছেন তারা অন্তত একটি বাল্যবিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এইসময়ে, লক্ষীপুরে শতকরা ৬৩, খুলনা ও নীলফামারিতে শতকরা ৫৬ জন।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের হার। যা শতকরা ৫৯ জন। বাল্যবিয়ের হার বেশি, বিশ্বের এরকম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে।
মূলত বয়:সন্ধিকালের মেয়েদের ও তাদের অভিভাবকদের বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত জ্ঞান বাড়ানোর জন্য, করোনাকালীন সময়ে বাল্যবিয়ের কারণগুলো কী ছিল, করোনাকালে বাল্যবিয়ে বন্ধে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাজ কতটা কার্যকর হয়েছে এবং বাল্যবিয়ে বন্ধে নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ কী হতে পারে, এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই এই জরিপটি চালানো হয়েছিল।
দেশের শতকরা ৩৩ ভাগ জেলায় করা এই জরিপে কথা বলা হয়েছে ১০-১৯ বয়সী অবিবাহিতা মেয়ে, ১৮ বছরের নীচে যাদের বিয়ে হয়েছে, সেইসব বাবা-মা, যাদের ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়ে আছে এবং সবধরণের সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের সাথে। তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে টেলিফোনে ও মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, এমজেএফের সহযোগী সংগঠনগুলো তথ্য সংগ্রহ করেছে।
ওয়েবিনারে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মারফি, জরিপের উপর মন্তব্য করেন ইউএনএফপিএ এর ডেপুটি রিপ্রেসেন্টিটিভ এইকো নারিতা ও ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেসেন্টিটিভ ভীরা মেনডোনকা।
জরিপের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কোঅর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ ও সিনিয়র ম্যানেজার গিয়াসউদ্দীন আহমেদ। এছাড়াও বাল্যবিয়ের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বক্তব্য রাখা হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জেনারেল সেক্রেটারি মালেকা বানু, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেয়ার বাংলাদেশের উম্যান এন্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রকল্পের ডিরেক্টর হুমাইয়রা আজিজ, আইসিডিডিআরবি’র সিনিয়র সাইনটিষ্ট রুচিরা তাবাস্সুম নাভেদ এবং আইসিটি ডিভিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি হাসিনা বেগম।
জরিপে আরো দেখা গেছে উত্তরদাতাদের শতকরা ৭৭ দশমিক ৯ জন ছেলে ও মেয়ে দেশে আইন অনুযায়ী বিয়ের বয়স সম্পর্কে সঠিকভাবে জানেন। বিভিন্ন এলাকার ম্যারেজ রেজিষ্টাররা ৪৮৬৬ টি বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন এই সময়ে। শতকরা ৩০ ভাগ উত্তরদাতা উল্লেখ করেছেন দারিদ্র এবং প্রতিদিনকার জীবনের টানাপোড়েনের কারণে তারা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
সকলেই স্বীকার করেছেনে সরকারি অফিস, স্থানীয় এনজিও, পুলিশ এবং হেল্পলাইনগুলো যথেষ্ট কার্যকর ছিল। অনেকক্ষেত্রে মেয়ে নিজে বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে। সাধারণত দারিদ্র, নিরাপত্তার অভাব, স্কুল বন্ধ, কম যৌতুক , পাত্রপক্ষের কাছে চাহিদা ইত্যাদি কারণেই বাল্যবিয়ে দেয়া হয়। সুপারিশমালায় উঠে এসেছে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তি বাড়ানোর কথা, গণমাধ্যমের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নেতাদেরকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করানো।
Leave a Reply