শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ডামি বা স্বতন্ত্র’ প্রার্থী রাখার যে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ, তাতে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি জায়গায় নেতারা একে-অপরকে হামলা করছে, দিচ্ছে হুমকি। ফলে বিবাদে জড়াচ্ছেন অনুসারীরা। মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তা আরও বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে দলের কেন্দ্র থেকেও ভাবা হচ্ছে।
প্রায় সব আসনেই স্বতন্ত্র মনোনয়ন জমা দিয়েছেন দলীয় নেতারা। এর মধ্যে, কোথাও বর্তমান এমপি বনাম স্থানীয় প্রভাবশালী আ.লীগ, আবার দলীয় স্থানীয় আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন মনোনয়ন না পাওয়া সংসদ সদস্য। সবাই আওয়ামী লীগের হওয়ায়, কেউ কাউকে কথাবার্তায়, আচরণে কোনও ছাড় দিচ্ছেন না। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গড়াচ্ছে হামলা-পাল্টা হামলায়। শেষ পর্যন্ত যদি মনোনয়ন প্রত্যাহার না করে এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিতে থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষে স্থানীয় এসব নেতাকর্মীদের ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাড. কামরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, ‘গত দুটি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন অনেক এমপি। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থা পড়েছিলাম আমরা। সেজন্য এবার নেত্রী বলেছেন, ডামি প্রার্থী রাখতে। অবশ্যই সেটি মূল প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হবে না। বরং তার সাপোর্টেড হবে। কিন্তু নেত্রীর সেই কথার ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খুব দ্রুতই এর সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি’।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে ৩০০টি আসনে মোট ২ হাজার ৭১৩টি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৩২টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রয়েছেন ১ হাজার ৯৬৬ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ৭৪৭ জন। এ মধ্যে সিংহভাগই আওয়ামী লীগের। কোনও কোনও আসনে একাধিক স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থী রয়েছেন। আর প্রার্থী হিসেবে নিজেদের প্রভাব দেখাতে গিয়ে এলাকায় জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলায়। কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ডও। আ.লীগ নেতাকে হুমকি দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা- এমন ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আ.লীগের প্রার্থী এনামুল হক শামীমের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগ নেতা খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। দু’পক্ষ থেকেই বিপুল পরিমাণ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এ সময় উভয় পক্ষের আহত হয়েছেন পাঁচ জন। তাদের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও মাজেদা শওকত হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওই দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে নড়িয়া বাজার এলাকায় এ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এরপর দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
এদিকে, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারজানা রাব্বি বুবলির গাড়ি বহরে হামলার অভিযোগ উঠেছে। তবে কে বা কারা হামলা করেছে এ ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ২০ সমর্থক আহত হয় এবং তাদের কমপক্ষে ৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা। ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি এলাকায় হামলা করা হয়।
বরিশাল-৫ (সদর) আসনের প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগে উত্তাপ ছড়িয়েছে এরই মধ্যে। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি জাহিদ ফারুককে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় বঞ্চিতরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত বরিশাল মহানগর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও মো. সালাহউদ্দিন রিপন নামে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
এরপর থেকেই প্রার্থী ও অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে কিছুটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের হাব খ্যাত এই আসনটিতে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নৌকা প্রার্থীর মনোনয়ন দিয়েছেন, তাই দলের সব ইউনিটকেই নৌকার পক্ষে কাজ করতে হবে। আর যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন তাদের নিজেদের লোক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে কাজ করতে হবে।
তবে, এরই মধ্যে মহানগর আ.লীগের শীর্ষ পদধারী নেতাকর্মীদের অনেককেই সাধারণ সম্পাদক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহে নৌকার ভোটের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে কি না, জানতে চাইলে উত্তরে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, এটি আমরা বলতে পারবো না। এ বিষয়ে নৌকার প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা বলতে পারবেন। আমরা আমাদের প্রার্থীর কথা বলতে পারবো।
এদিকে, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে তাকে বহিষ্কারের দাবিতে ঝাড়ু মিছিল করেছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। পাশাপাশি তার ছবিও পোড়ানো হয়েছে।
ঝাড়ু মিছিল ও ছবিতে আগুন দেওয়ার ঘটনার পেছনে সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীর অনুসারীরা রয়েছেন বলে দাবি করেছেন এম এ মোতালেব। তিনি বলেন, ‘নদভীর লোকজন নির্বাচনের শুরুতেই অন্যায় করছেন। তারা ঝাড়ু মিছিল ও ছবিতে আগুন দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করেছেন। তাছাড়া, উপজেলার দেওদীঘি এলাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় কিছু লোককেও আটকে রেখেছিলেন তারা।’
গত বুধবার কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ১২ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনা সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নবী হোছাইনের নেতৃত্বে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। নবী হোছাইন বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের অনুসারী। তবে নবী হোছাইন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আ.লীগ নেতাকর্মীরা বলেন, মনোনয়ন পাওয়ার পর সেদিন বিকেল চারটায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদ চকরিয়ায় ফেরেন। তাকে বরণ করতে চকরিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নেতাকর্মীরা হারবাং এলাকায় জড়ো হন। হারবাং যাওয়ার পথে সাহারবিলের রামপুর এলাকায় সাহারবিল ইউপি চেয়ারম্যান নবী হোছাইনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে সাহারবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হকসহ অন্তত ১২ নেতাকর্মী আহত হন। একই সঙ্গে বহরের অন্তত ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান সমর্থিত নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন। তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) সংসদীয় আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার কথা ছিল। বেলা ১০টার দিকে কলাপাড়া পৌর শহরের গোডাউন ঘাট এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এসএম মনিরুল ইসলাম (৫০) এবং উপজেলা যুবলীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক অসীম তালুকদার (৫২)। তাদের কুপিয়ে জখম করেছে কতিপয় সন্ত্রাসীরা। আহত দুজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমানের সমর্থক। এ সহিংস ঘটনায় বর্তমান সংসদ সদস্য মো. মহিবুর রহমানকে দায়ী করেছেন মাহবুবুর রহমান।
তিনি অভিযোগ করে জানান, তার মনোনয়নপত্র দাখিল উপলক্ষে পূর্বনির্ধারিত মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠানে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে এমপি মহিবুর রহমানের কর্মীরা বাধা দিয়েছে। এ ছাড়া, সন্ত্রাসীদের হামলায় তার আরও ১৫ জন নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
আ.লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে-পরে এমন ঘটনা ভাবাচ্ছে দলকে। যে কৌশলে ডামি প্রার্থী রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছিল, নেতারা সেটি রাখছেন না। তারা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। এর রেশ টেনে ধরতে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেই বিষয়টির সমাধান করতে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গণমাধ্যমে বলেন, ‘সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল প্রার্থীর পক্ষে ডামি প্রার্থী দেওয়া। কিন্তু সেটি এখন বিপরীত হয়ে গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, সেটি বলা হয়নি। আমরা এই বিষয়ে দলীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি প্রত্যাহার না করে, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: রাইজিংবিডি
Leave a Reply