শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৬ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলার ৪ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন। তাঁদের মধ্যে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় আহত হন পুলিশের অনেকে। পরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডোদের উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর একজন পাচক নিহত হন। এই অভিযানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি দশা। রেস্তোরাঁর আটক আরেক কর্মী পরে হাসপাতালে মারা যান।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস জঙ্গি হামলায় ইতালির ৯ জন, জাপানের সাত জন, ভারতীয় একজন ও বাংলাদেশি তিন জন নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। হামলার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার (১ জুলাই) সকাল থেকে নিহতদের স্বজনরা শ্রদ্ধা জানাবে। করোনা দুর্যোগের মধ্যে সীমিত পরিসারে শিডিউল মেনে জাপান, ইতালি এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতগণ শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন। ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন ওই জঙ্গি হামলা সাধারণের মতো চমকে দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। সন্ত্রাস, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও বিছিন্ন জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা মোকাবেলা করে অভ্যস্ত পুলিশ- র্যাবকে ওই প্রথম জঙ্গিদের সরাসরি মোকাবেলার পরীক্ষায় পড়তে হয়। দমনে মাত্র চার মাস আগে গঠন করা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরাও এই হামলা সম্পর্কে প্রথমে বুঝতেই পারেননি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় বন্দুকধারী জঙ্গিরা। ওই দিন রাতেই তারা দেশি-বিদেশি মোট ২০ জনকে হত্যা করে। বিদেশি যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ইতালি, জাপান ও ভারতের নাগরিক। হামলার দিন উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত হন পাঁচ হামলাকারী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেক জঙ্গির মৃত্যু হয়।
হামলাকারী জঙ্গিরা হলেন— রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে। সংগঠনটির মুখপত্র আমাক হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে বলে জানায় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স।
এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ও কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্যবসায়ী শাহরিয়ার খানের ছেলে তাহমিদকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দুই দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে অবশ্য তাহমিদকে গুলশান মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে পুলিশকে অসহযোগিতার মামলা দেয় পুলিশ। সে মামলায় তাহমিদ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে খালাস পান।
গুলশানের ভয়বাহ হামলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরী, জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, সারোয়ার জাহান, আব্দুল্লাহ মোতালেব, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান।
হলি আর্টিজানে হামলায় ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মোট ২১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। হামলার দুই বছর পর আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে ওই ২১ জনের নামই দেওয়া হয়। তবে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জনই বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন। ওই ১৩ জনের পাশাপাশি হাসনাত করিমকেও অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর ও চার্জশিট জমা দেওয়ার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হলি আর্টিজান মামলার রায় হয়। রায়ে সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন— গাইবান্ধার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নওগাঁর আসলাম হোসেন ওরফে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ, কুষ্টিয়ার আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, জয়পুরহাটের হাদীসুর রহমান ওরফে সাগর, বগুড়ার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও রাজশাহীর শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ। খালাস দেওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে।
যেভাবে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা
গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলা চালানো পাঁচ তরুণ সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘থান্ডারবোল্টে’ সেদিনই নিহত হয়েছিলেন। নিহতরা জঙ্গিরা হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
সুপরিকল্পিত ওই অভিযানে ৫ জঙ্গি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার উদ্দেশে রওনা হয়।
২০১৬ সালের ১ জুলাই বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে কাঁধে থাকা ব্যাগে অস্ত্র-গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হয়ে রাত ৮টা ৪২ মিনিটের দিকে সেখানে পৌঁছে।
প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের এবং একটু পর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হলি আর্টিজানের মূল ফটকে যায়।
ফটকের নিরাপত্তাকর্মী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নিরাপত্তাকর্মীর ডান চোখের নিচে ঘুষি মেরে তারা হলি আর্টিজানের ভেতর ঢুকে যায়। ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
৩০ মিনিটের মধ্যেই পাঁচ জঙ্গির কাছে থাকা অস্ত্র-গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে দেশি-বিদেশিদের হত্যা করে। বিভিন্ন রুম, টয়লেট, চিলারঘর, হিমঘর ইত্যাদি স্থান থেকে বিদেশিদের বের করে এনে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়।
একপর্যায়ে তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট : উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের আদেশক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও র্যাব সহযোগী সম্মিলিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।
সকাল ৭টার দিকে প্যারা কমান্ডো হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট রেকি করে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়।
প্যারা কমান্ডো সদস্যরা ক্রলিং করতে করতে সামনে দিকে এগোতে থাকে এবং গুলি ছুড়তে থাকে পদাতিক ডিভিশন ও স্লাইপার টিম। এ সময় জঙ্গিরাও গুলি ছুড়তে থাকে।
১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যে সব সন্ত্রাসী নির্মূল করে প্যারা কমান্ডো টার্গেট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পরে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযানের সমাপ্তি ঘটে।
অভিযানে এক জাপানি ও দু’জন শ্রীলংকার নাগরিকসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
Leave a Reply