বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২২ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥ এইচ এম হেলাল :
শারীরিক সুস্থতা লাঘব ও এক ঘেয়েমি কাটাতে বন্ধুবর এক সংবাদকর্মীকে নিয়ে শনিবার রাতে রওয়ানা দিলাম দূরযাত্রায়। হঠাৎ মনের জানালায় উঁকি দিলো বরিশালের নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মুখখানি। নির্বাচনপূর্ব তার সাথে আমার দারুণ সখ্যতা ছিল। বলা যায় বন্ধুত্বপূর্ণ। জোর গলায় বলতে পারি তখন তার রাজনৈতিক দুর্দিনে অনেক সংবাদকর্মী কালিবাড়ি তার বাস ভবনমুখি হতে দেখিনি। মিডিয়াও তার বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার। সেই মুহূর্তে নানা প্রসঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে তার সান্নিধ্য লাভ এবং তখন থেকেই এই যুব বয়সী রাজনীতিকের গতিপথ ও মন-মানসিকতা যাচাই করছিলাম অত্যন্ত কৌশলে।
দেখেছিলাম তার সরলতা এবং স্বচ্ছতার কিছু নমুনা। দিনোত্তর এই নেতার মধ্যে আসা ভাব এবং তার চারপাশে কিছু মানুষের ঘোরাফেরা দেখে ভেবে নিলাম আমাদের মত মানুষের এ রাজ্যে আর আসা ঠিক নয়। সেই থেকে তার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ মেলেনি বা নিজের মধ্যে ইচ্ছাও তৈরী হয়নি। মেয়র নির্বাচনকালীন এবং পরবর্তী নানা কর্মকান্ডে মনে হয়েছিল এই রাজনীতিবিদ মেয়র নির্বাচিত হয়ে নতুন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন। হাব-ভাব ও চলন-বলন সর্বোপরি তার নানা প্রতিশ্রুতিতে আবার মুগ্ধ হই। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সাদিক আবদুল্লাহর মানসিক ইতিবাচক এই পরিবর্তন প্রসঙ্গে একটি লেখার প্রয়োজনীয়তা আমাকে তাড়িত করলো।
চলন্ত গাড়িতে বসে ‘এই সাদিক আর সেই সাদিক এক নয়’ শিরোনামে একটি ইতিবাচক লেখা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই। রাত তখন দেড়টা। দীর্ঘকায় লেখাটির সমাপ্তির পর মনে হল পাঠক মহল হয়তো লেখাটি পড়ে ভাবতে পারেন তৈল মর্দনের ন্যায় নিজেকে তোষামোদিদের কাতারে সামিল হয়েছি। পাঠকের ভাবনা একান্তই তার নিজের। তবে আমার ভাবনা আমারই। সেখান থেকেই এই লেখা। কিন্তু রাত আড়াইটার দিকে ¯েœহভাজন এক সংবাদকর্মী সেলফোনে সাদিক আবদুল্লাহ প্রসঙ্গে যা জানালেন তা আমার লেখার একেবারেই বিপরীত। ভাগ্য সহায়, আমার লেখার জন্য তোষামোদি হিসেবে শুধু জানালো- আপনার সাদিক ভাইয়ের কথার সাথে কাজের মিল কোথায়? এখনো দায়িত্ব নেননি কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি দখল নিয়েছেন।
একটু বিস্মিত হলাম এবং কিছুটা সময় থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম- ঘটনাটা কি? উত্তরে পরিস্কার জানিয়ে দিল- ঢাকা থেকে বিমানে এসে বরিশালে নামার পর সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে চেপে তিনি বাসায় পৌছান। তার ভাষ্য অনুযায়ী- বরিশাল বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আনুষ্ঠানিকতা না থাকলেও সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাথে ছিল কর্পোরেশনের আরো দুটি গাড়ি। দলীয় নেতা-কর্মীতো ছিলই। পূর্বেকার ন্যায় বরিশার প্রত্যাবর্তনে নেতাকে নিয়ে যে ধরনের শোডাউন দেওয়া হয় এবার ব্যতিক্রম ঘটলেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি ব্যবহার নিয়ে। মেয়র হিসেবে শপথ এবং আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার গ্রহণ না করে কিভাবে সিটি কর্পোরেশন তথা সরকারি গাড়ি তিনি ব্যবহার করলেন তা আমার বোধগম্য হলো না। নির্বাচনপূর্বপর এই সাদিক আবদুল্লাহই বলেছিলেন- তিনি অনৈতিক কোনো সুবিধা নেবেন না। থাকতে চান বিতর্কের বাইরে।
অনেকের সন্দেহ ছিল- হয়তো এমনটি তিনি বাস্তবে দেখাতে পারলেও তার বেপরোয়া নেতা-কর্মীদের কতটুকু সামাল দিতে পারবেন? তারাই তো তাকে বিতর্কের জালে লটকে দেবেন। অতদূর যেতে হলো না, বরং নিজেই বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে চেপে। স্বল্পদিনে আমি যতটুকু তাকে চিনি এ ধরনের নির্বোধ কর্ম তার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ তাই করলেন (!)
ধারণা হচ্ছে- হয়তোবা যুব বয়সে ক্ষমতার ভার সইতে পারেননি। অথবা তার চারপাশে থাকা তোষামোদকারীদের ফাঁদে পড়ে নিজেকে বিগড়ে ফেলেছেন। নচেৎ নিজের বিলাসবহুল দামি গাড়ি থাকতেও কেন কর্পোরেশনের একটি নরমাল গাড়িতে তিনি চেপে বসলেন? রাতে স্ববিস্তর খোঁজ খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফেসবুক মেসেঞ্জারে সেই গাড়ির ছবি দিয়ে কোনো এক বন্ধু প্রশ্ন রেখেছেন- ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে লিখলেন নয়া মেয়র রাজনীতিতে নতুন কোন আইডল হতে যাচ্ছেন? অনেকটা ব্যঙ্গাত্মক সুরে বললেন- এই কি তার নমুনা? গাড়িতে হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেল মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে।
পরিস্কার চিহ্নিত করাও গেল ওই গাড়িটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওয়াহেদুজ্জামান ব্যবহার করতেন। বিদায়ী এই কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে ফেনী জেলা প্রশাসক হিসেবে সদ্য যোগদান করেছেন। গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায়ই কর্পোরেশনের গ্যারেজে রাখা ছিল। অন্যদিকে নয়া মেয়রের ব্যবহারের জন্য কর্পোরেশনের অর্থায়নে নতুন মডেলের একটি দামি গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ভাগ্য সহায়, সেই গাড়িটি বিমান বন্দর পর্যন্ত পৌছায়নি। যদি যেত তাহলে হয়তো সাদিক আবদুল্লাহকে সেই গাড়িতেই দেখতে পাওয়া অসম্ভব ছিল না।
সর্বশেষ যে তথ্য পেলাম তাতে স্বচ্ছভাবে নিশ্চিত হলাম- সিটি কর্পোরেশনের সবাই এখন সাদিক আবদুল্লাহর বন্দনায় দিন পার করছে। দায়িত্ব নেয়নি, তবুও এই নয়া মেয়রকে কিভাবে রাজি-খুশি করা যায় তার চেষ্টার অংশ হিসেবে বিমান বন্দরে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানালেন, দুপুর দেড়টায় ইউএস বাংলা বিমানে সাদিক আবদুল্লাহ বরিশালে আসেন। তিনি গত এক সপ্তাহকাল ঢাকায় অবস্থান করছিলেন শপথ গ্রহণ প্রত্যাশায়। কিন্তু বরিশালে ভোট নিয়ে অনিয়ম অভিযোগ তদন্ত চলমান থাকায় সরকারি গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র বলছে, সম্ভবত আগামী মাসে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে চলতি মাসের মধ্যে গেজেট প্রকাশের যে জটিলতা রয়েছে তার সমাপ্তি ঘটতে পারে। শপথ নিলে কথা ছিল না।
কিন্তু ঢাকা থেকে বরিশালে স্বাভাবিক আগমনে এমন কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল যে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমান বন্দরে যেতে আগ্রহী হলেন? আর কোন বিবেকে তাকে সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে তুলে বাড়িতে পৌছে দিলেন? তোষামোদীরা ভালবাসলেন না যেন বিতর্কের জলে ভাসিয়ে দিলেন নয়া মেয়রকে। তা কি তিনি উপলব্ধি করেছেন? আারো একটি প্রশ্ন জাগে- এসময় সাদিক আবদুল্লাহর এমন কোনো শুভাকাক্সক্ষী কি সেখানে ছিলেন না যে এই ভুলটি শুধরে দেওয়ার মত? সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতো দূরের কথা, নিজের দামি গাড়িও নয় বরং সাদামাটা কোনো গাড়িতে তিনি বাড়ি ফিরলে নগরবাসীর বাহবাই পেতেন।
বলা বাহুল্য যে, সাদিক আবদুল্লাহ আবেগে উৎফুল্ল হওয়ার কথাই। কিন্তু বিবেচনায় আনলেন না তিনি এখনো ক্ষমতা নেননি। সেক্ষেত্রে কেন তিনি এ ধরনের গাড়িতে চড়ে বিতর্কের জালে জড়াতে গেলেন? বুদ্ধিমানরা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিলে হয়তোবা নীরবে তা অনুধাবন করে লজ্জায় কাতরান। সাদিক আবদুল্লাহও এর ব্যতিক্রম হবেন না বলে মনে করি।
কিন্তু আমার মত ক্ষুদ্র লেখক রাতে লিখলাম নয়া মেয়রকে নিয়ে ইতিবাচক কথা, দিনের আলোতে এসে লিখতে হল বিতর্কিত কাহিনীর নেতিবাচক কথা। কাকতালীয়ভাবে আমিও হলাম বিতর্কিত। এ লজ্জা লুকিয়ে রাখি কোথায়? নতুন করে সমালোচনার প্রতিধ্বনি কানে বাজছে- শুরুতেই যখন গলদ তার শেষ কি হবে আল্লাহই জানে।
Leave a Reply