বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন
কুয়াকাটা প্রতিনিধি॥ পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসে অনেক পর্যটক আবাসিক হোটেলে ওঠেন। এরমধ্যে ‘আল-মদিনা’ও একটি। হোটেলটির বেশ সুনাম রয়েছে। আর এ সুনাম অক্ষত রাখতেই মার্জিয়া আক্তার কান্তার লাশ বস্তায় ভরে সাগরে ভাসিয়ে দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুলিশি ঝামেলা এড়াতে তারা লাশটি সাগরে ভাসিয়ে দেয়।
প্রায় দুই বছর আগে স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরের সঙ্গে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যান মার্জিয়া আক্তার কান্তা। ওই সময় স্ত্রীকে নিয়ে আবাসিক হোটেল আল-মদিনার বি-১ নম্বর কক্ষে ওঠেন শহিদুল। পরে কান্তাকে গলা টিপে হত্যা করে পলিথিনে লাশ মুড়িয়ে খাটের নিচে রেখে পালিয়ে যান তিনি। অবশেষে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদীর পিবিআই’র পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান জানান, কান্তা নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার সোহরাব হোসেন রতনের মেয়ে। তিনি ঢাকার আশুলিয়ায় বিউটি পার্লারের ব্যবসা করতেন। সেখানে কুড়িগ্রামের রৌমারীর শহিদুল ইসলাম সাগরের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর দুই লাখ টাকার কাবিননামায় তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের কিছুদিন পর কান্তা জানতে পারেন স্বামীর আরো এক স্ত্রী রয়েছেন। বিষয়টি গোপন করে তাকে বিয়ে করায় সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না কান্তা। এ নিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরকে প্রতারক হিসেবে তুলে ধরাই কাল হলো কান্তার।
এ ঘটনায় কৌশলের আশ্রয় নেন সাগর। ভালোবাসার অভিনয় করে ভারতে বেড়াতে নেয়ার কথা বলে কান্তার মন জয়ের চেষ্টা করে সফলও হন তিনি।
এরপর ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আশুলিয়া থেকে প্রথমে শরীয়তপুরে আবাসিক হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনালে আসেন কান্তা ও সাগর। সেখানেই তারা রাত কাটান। এছাড়া সেখানে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সাগরের মামাতো ভাই মামুন। এর পরদিন স্বামী-স্ত্রী শরীয়তপুর থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশে এসে আবাসিক হোটেল আল-মদিনার বি-১ নম্বর কক্ষে ওঠেন। কোনো এক সময়ে কান্তাকে গলা টিপে হত্যা করে পলিথিনে লাশ মুড়িয়ে খাটের নিচে রেখে পালিয়ে যান সাগর ও মামুন।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে ওই হোটেল কক্ষে তালা ঝুলতে দেখে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মহিপুর থানা পুলিশকে খবর দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ কান্তার ব্যবহৃত জামাকাপড় উদ্ধার করে নিলেও খাটের নিচে লাশ থাকার বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি।
এর দুইদিন পর ওই কক্ষ থেকে দুর্গন্ধ বের হলে হোটেল ম্যানেজার আমির এবং হোটেল বয় সাইফুলের নজরে লাশটি আসে। পরে তারা বিষয়টি হোটেল মালিক দেলোয়ারকে জানান। এরপর দেলোয়ার, তার ছোট ভাই আনোয়ার, ম্যানেজার আমির ও বয় সাইফুল মিলে হত্যার আলামত নষ্ট করে লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১১টায় বস্তায় ভরে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে দেলোয়ার ও আনোয়ার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুচর এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে গলা সমান সাগরের পানিতে নেমে লাশ ভাসিয়ে দিয়ে দুই ভাই হোটেলে ফিরে আসেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে আর কোথাও মুখ খোলেননি তারা।
এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি শহিদুল ইসলাম সাগরসহ তার পরিবারের পাঁচজনের বিরুদ্ধে নরসিংদী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হত্যার পর লাশ গুমের মামলা করেন নিহতের বাবা সোহরাব হোসেন রতন।
আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে নরসিংদীর বেলাবো থানায় এজাহার হিসেবে গণ্য করে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে পিবিআই মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয়। অভিযুক্ত স্বামী শহিদুল ইসলাম সাগরকে গ্রেফতারের পর তদন্তের হালে পানি পায়। এরপর সহযোগী মামাতো ভাই মামুনকেও চলতি বছর ১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়।
মামুনের দেয়া তথ্যমতে তাকে নিয়ে কুয়াকাটার আবাসিক হোটেল আল-মদিনায় বৃহস্পতিবার অভিযানে যায় পিবিআই। সেখানে গেলে মার্জিয়া কান্তার লাশ গুমের সত্যতা খুব সহজেই স্বীকার করেন হোটেল মালিক দোলোয়ার ও তার ছোট ভাই আনোয়ার, হোটেল ম্যানেজার এবং বয় সাইফুল। পরে তাদেরও গ্রেফতার করা হয়। এরপর কুয়াকাটা থেকে চারজনকে নরসিংদী নিয়ে যায় পিবিআই।
মামলার তদন্তের বিস্তারিত অগ্রগতি তুলে ধরে পিবিআই তাদের নরসিংদী কার্যালয়ে শনিবার বিকেলে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। গ্রেফতাররা হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুমের সত্যতা স্বীকার করেছে বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী পিবিআই’র পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। এছাড়া গ্রেফতারদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মহিপুর থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, হোটেলে অবস্থানকারীরা ভাড়া পরিশোধ না করেই তাদের ব্যবহৃত কিছু জামা কাপড় রেখে পালিয়েছে মর্মে হোটেল আল-মদিনার পক্ষ থেকে পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ ওইসব ব্যবহৃত জামাকাপড় তখন উদ্ধার করে থানায় রাখে। পরবর্তীতে খাটের নিচে লাশ পাওয়ার বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে হোটেল মালিক ও কর্মচারীরা আলামত নষ্ট করে লাশ গুম করে।
Leave a Reply