সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭ অপরাহ্ন
বাকেরগঞ্জ প্রতিনিধি॥ বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের পাশের একটি শয্যায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন নাহিদা আকতার (৩৫)। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন স্বজনেরা। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই যে নাহিদাকে শান্ত করতে পারছিল না। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন, ‘কেন আমাগো সব আনন্দ মাটি অইয়্যা গ্যালো, কেন, কেন…?’ নিরুত্তর উপস্থিত স্বজনসহ সবারই চোখ ছিল ছলছল।
নাহিদা যখন বিলাপ করছিলেন, তখন বাসচাপায় তাঁর নিহত বোন সাথীর ১৮ মাসের মেয়ে ফারহানা জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুই বোনের মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান নাহিদা সংবিৎ ফিরে পেতেই বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ফারহানা কেমন আছে, আমার ফারহানা কই…?’ পাশে থাকা স্বজনেরা বলছিলেন, ও ভালো আছে। বিকেল চারটার দিকে শিশু ফারহানাও হাসপাতালে মারা যায়। আজ বুধবার বেলা পৌনে একটায় বাকেরগঞ্জ পৌরসভার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসংলগ্ন চৌমাথা এলাকার কুয়াকাটা-বরিশাল মহাসড়কে তাঁদের বহনকারী ইজিবাইককে চাপা দেয় বিপরীত দিক থেকে আসা বিআরটিসির একটি বাস। ঘটনাস্থলে চারজন মারা যান। দুজন মারা যান হাসপাতালে।
ঘটনাস্থলে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন নাহিদার আরেক বোন তানজিলা আক্তার (৩০), ইজিবাইকের যাত্রী আমির চৌধুরী (৬০), মো. হাসিব (২৫) ও ইজিবাইকের চালক মো. সোহাগ (২৪)। গুরুতর আহত অবস্থায় ইজিবাইকের অপর তিন যাত্রী সাথী আক্তার (২২), তাঁর ১৮ মাস বয়সী মেয়ে ফারহানা ও স্বামী ফয়সাল হোসেনকে (৩৩) উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর বেলা দুইটায় সাথী আক্তার এবং বিকেল চারটায় তাঁর মেয়ে ফারহানা মারা যায়। তানজিলা ও সাথী আপন বোন। তাঁরা বাকেরগঞ্জের কলসকাঠীর নারঙ্গল গ্রামের হারুন মিয়ার মেয়ে। হারুন মিয়ার ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। এর মধ্যে চার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। নাহিদা ও তানজিলা স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। আরেক বোন সাথীর বিয়ে হয়েছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। পঞ্চম বোন বীথি আক্তারের বিয়ের দিন ধার্য ছিল আগামী শুক্রবার। বরের বাড়ি মাদারীপুর জেলায়।
এসব তথ্য জানিয়ে নাহিদার স্বামী শাহাদাত হোসেন বলেন, বীথির বিয়ে উপলক্ষে তিনি স্ত্রী নাহিদা, শ্যালিকা তানজিলা ও তাঁর স্বামী নাসির উদ্দীনসহ সন্তানদের নিয়ে আজ সকালে ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়ি বাকেরগঞ্জের নারঙ্গল গ্রামে আসেন। এর আগের দিন বরিশালের গৌরনদী থেকে সাথী আক্তার তাঁর মেয়ে ফারহানাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আসেন।
আজ সকাল ১০টার দিকে সাথী আক্তার তাঁর মেয়ে ফারহানা ও বোন তানজিলাকে নিয়ে বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদরে যান বিয়ের বাজার–সদাই করতে। সেখানে গৌরনদী থেকে এসে যোগ দেন সাথীর স্বামী ফয়সাল আহমেদ। তাঁরা সবাই মিলে বিয়ের জন্য মুরগি, মসলাপাতি, সবজি এবং অন্যান্য বাজার–সদাই করে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে বাস চাপা দেয় তাঁদের বহনকারী ইজিবাইকটিকে।
দুর্ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কেনা ১০-১২টি মুরগি, আলু, পটোল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য বাজার-সদাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পা বাঁধা মুরগিগুলো মরে পড়ে আছে সড়কের এখানে-ওখানে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শাহাদাত মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে আছি। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি, কীভাবে লাশগুলো আমরা নিতে পারব। পরিবারের সবাই তো এখন শোকাতুর। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। আমরা লাশগুলোর ময়নাতদন্ত না করে নেওয়ার পক্ষে।
বাকেরগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার রাতে বলেন, ওই পরিবারের পক্ষ থেকে একজন ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। তবে এর জন্য কিছু আইনগত বিষয় আছে। এ জন্য লিখিত আবেদন করতে হবে। তারপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। কেউ মামলা করতে চায়নি। পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে মামলা না হলে পুলিশের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ী মামলা হবে।
বরিশাল বিআরটিসি ডিপো সূত্র জানায়, বরিশাল ডিপোর ওই বাস দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় বরগুনার তালতলী থেকে বরিশাল পথে চলাচল করত। বাসটি কুমিল্লার গিয়াস উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি ইজারা নিয়ে পরিচালনা করতেন। এর চালকও ইজারাদারের নিযুক্ত ছিলেন।
জানতে চাইলে বিআরটিসির বরিশাল ডিপোর ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাসটি তাঁদের ডিপোর হলেও দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় বরিশাল-তালতলী পথে চলছিল। বাসের চালক বিআরটিসির নিয়োগপ্রাপ্ত নয়। এ ঘটনায় বিআরটিসির পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply