শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৭ অপরাহ্ন
এম. কে. রানা, নিজস্ব প্রতিনিধি॥ ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। নদী খালের এ সৌন্দর্য দেখে কবি নজরুল বরিশালকে ”বাংলার ভেনিস” নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। নদী ও খালকে বরিশালের প্রাণ প্রবাহও বলা হলেও এখন তা অতীত। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, দখলদারদের থাবায় বরিশালের ২২টি খালের মধ্যে কোনমতে বেঁচে আছে নগরীর মধ্যে প্রবাহিত পাঁচটি প্রধান খাল। সেগুলো হল সাগরদী খাল, আমানতগঞ্জ খাল, জেল খাল, লাকুটিয়া খাল ও ভাটার খাল।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার বা উন্নয়ন করা না হলে জীবিত এ ৫টি খালেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন সচেতন মহল। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নগরীর ২২টি খাল পুনরুদ্ধার ও সংস্কার, তীর সংরক্ষন ও সৌন্দর্য বর্ধন এবং অভ্যন্তরীন সড়ক ও ড্রেনেজ সংস্কারের জন্য ৩৩শ’ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্প দুটি পাশ হলে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষাসহ নগরীর অবকাঠামোগত চেহারা পাল্টে যাবে। তবে শুধু আশার বানীতেই আটকে আছে বরিশালের ২২টি খাল উন্নয়ন কাজ।
বরিশালের প্রাণখ্যাত ঐতিহ্যবাহী জেল খালসহ ২২টি খাল দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করতে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সর্বকালের স্মতঃস্ফুর্ততার উদাহরন সৃষ্টি করে হাজার হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে ঐতিহ্যবাহি জেল খালটিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। সে সময়কার জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামান ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক জানিয়েছিলেন, জেল খাল উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প শীঘ্রই পাস হবে। তবে ওই প্রকল্প আজও আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৮ সালের ২২ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভায় জেল খাল উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়াহেদুজ্জামান, এনজিও কর্মকর্তারা, সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর ও সাংবাদিকরা। বরিশাল জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান জানিয়েছিলেন, জেলখালসহ নগরীর সবগুলো খাল নিয়েই একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে শীঘ্রই বরিশালের সবগুলো খান পুন:খনন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রকল্প কাজ শুরু হবে। আর শুরুটাও হয়েছিল নগরীর নথুল্লাবাদ থেকে। তবে বেকু দিয়ে খাল থেকে শুধু ময়লা উঠানো হয়েছিল। যার কাউনিয়া মরকখোলা পোল পর্যন্ত এসে থেমে যায়।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরের খালগুলো খনন, তীর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য আড়াইহাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা অধিশাখার যুগ্ম প্রধান আবু মোঃ মহিউদ্দিন কাদেরী জানান, অনেকদিন আগে দুটি প্রস্তাবনা এসেছিল। তবে এখন তা কোন পর্যায়ে রয়েছে তা তিনি বলতে পারেননি। এছাড়া ওই প্রকল্প সম্পর্কে বরিশালে যারা রয়েছেন তারা ভাল বলতে পারবেন বলেও জানান তিনি। এদিকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসরাইল হোসেন এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য দিতে রাজী হননি।
বরিশাল শহরের মাঝে বয়ে যাওয়া ২২টি ছোট-বড় খালের বেশিরভাগই এখন নগরবাসীর বাসা-বাড়ির সুয়ারেজ লাইনের পানি কিংবা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খননের অভাব ও দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নাব্য সংকটের পাশাপাশি প্রশস্ততা কমে এগুলোর অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যায়না। হঠাৎ করে দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে এখানে খাল আছে বা ছিল। এদিকে উজানের বন্যার পানির চাপ, অমাবশ্যার জো’র প্রভাব এবং অব্যাহত বৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি উপচে লোকালয় সহ বির্র্স্তিন এলাকা তলিয়ে যায়। বিশেষ করে নগরীর বেশীরভাগ এলাকা তলিয়ে চরম জনদুর্ভোগের সৃস্টি হয়। টানা ৫দিন দুই বেলা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে নগরী সহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিস্তির্ন এলাকা ফসলি জমি, মাছের ঘের, বাজারঘাট সর্বত্র তলিয়ে যায়।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, বরিশালের খালগুলো যেভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে, তাতে শুধু ওপর থেকেই পরিষ্কার দেখায়। কিন্তু খনন না করায় খালের নিচে বেশ পুরু একটা ময়লা-আবর্জনার স্তর পড়েছে। ফলে নতুন করে ময়লা ফেললে কয়েকদিনের মাথায় খাল ভরাট হয়ে যায়। এসব খাল রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় বাসিন্দা প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা ভাটারখাল অস্তিত্ব সংকটে। চাঁদমারি খালও জেলা প্রশাসকের বাংলো বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে এসে শেষ হয়ে গেছে, এরপর আর সেই খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার চাঁদমারী খালের স্টেডিয়াম পয়েন্টে গিয়ে দেখবেন, বহু দোকান গড়ে তোলায় খালের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের আমলে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। পরে সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে এবং প্রশাসনিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ফলে উচ্চ পর্যায়ে যে সকল কর্মকর্তা ছিলেন তারা না স্ব স্ব পদে না থাকায় কোন সহযোগিতা না করা করায় প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা সৃষ্ঠি হয়েছে। এ প্রকল্পের তদ্বির করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধির অর্থাৎ মেয়রের। তাকেই এর দায়ভার নিতে হবে। অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়রগণ তদ্বির চালিয়ে প্রকল্প পাস করিয়ে আনলেও বিসিসির প্রকল্প পাস না হওয়ার দায়িত্ব মেয়রের উপরই বর্তায়।
তিনি বলেন, খালগুলো খনন করা হলে আজকের এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। যে জনগণকে আমরা ২০১৬ সালে উদ্ধুদ্ধ করেছিলাম তারা এখন হতাশ। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন বা জেলা প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট সকল দফরের উচিত বিষয়টি সরকারের নজরে এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েনের মতে, যে কোনো উপায়ে নগরের খালগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
পরিবেশবিদ রফিকুল আলম বলেন, খালগুলোকে পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে নিতে হলে সামাজিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। যারা এগুলোর দখল-দূষণ করছে তাদের সচেতন করতে হলে সামাজিক সমন্বয় প্রয়োজন, কারণ তারা সবাই রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত।এ ব্যাপারে জানতে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply