বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ অপরাহ্ন
তবিবুর রহমান॥ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা। নানা উদ্যোগেও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এতে প্রাণহানি যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়েই চলেছে সম্পদের ক্ষতিও। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে লাখে ১৫ দশমিক ৩ জন মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়।
আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় মারা যাওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলন সুনির্দিষ্টভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বল দিকগুলো দেখিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের পর সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাস এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা-২০২০ গ্রহণসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার। এর মাধ্যমে সরকার সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যদিও এ লক্ষ্য অর্জনে বড় কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহারে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সড়কে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি ভারতে। দেশটিতে লাখে ২২ দশমিক ৬ জনের মৃত্যু হয় সড়কে। এছাড়া ভুটানে প্রতি লাখে ১৭ দশমিক ৪, নেপালে ১৫ দশমিক ৯, বাংলাদেশে ১৫ দশমিক ৩, আফগানিস্তানে ১৫ দশমিক ১, শ্রীলংকায় ১৪ দশমিক ৬ ও পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৩ জনের মৃত্যু হয় সড়কে।
জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে সড়ক আইনেই সমস্যা রয়েছে। এছাড়া যে আইন বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না ঠিকমতো। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা রয়েছে। শুধু আইন করে সমাধান হবে না, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সড়কে যানগুলো আয় বাড়াতে সময় মেনে চলতে চায়। এখানে একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক যানের চালকের লাইসেন্স, ফিটনেস, চলাচলের অনুমতি কোনোটাই ঠিক নেই। একটা অনিয়মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব কারণে সবচেয়ে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সড়কের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ চিত্রে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের সড়ক রয়েছে ভারতের। সড়কের মানের ক্ষেত্রে ভারতের পর রয়েছে পাকিস্তান। এরপর তৃতীয় স্থানের রয়েছে শ্রীলংকা ও চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ।
পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো সড়ক হচ্ছে মালয়েশিয়ার। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চীন। আর থাইল্যান্ড তৃতীয়, ইন্দোনেশিয়া চতুর্থ ও কম্বোডিয়া পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সড়কের মান সর্বোচ্চ ভালো সিঙ্গাপুরের। এরপর রয়েছে জাপান, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের অবস্থান।
এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গাড়ির কালো ধোঁয়ার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ করে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করছে ভারত। বছরে ২৫৬ টন কার্বন নিঃসরণ করে দেশটি। ৫২ দশমিক ৬ টন কার্বন নিঃসরণ করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ১০ দশমিক ৬ টন নিঃসরণ করে শ্রীলংকা তৃতীয় ও ৮ দশমিক ৪ টন কার্বন নিঃসরণ করে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে।
এদিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ করে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। দেশটি বছরে ৭২৬ টন কার্বন নিঃসরণ করে। চীনের পর ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান। তারা প্রতি বছর ১২৪ দশমিক ৫ টন কার্বন নিঃসরণ করে। ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। এর পরের অবস্থান মালয়েশিয়ার। দেশটি প্রতি বছর ৫৮ দশমিক ৯ টন কার্বন নিঃসরণ করে। ৩০ টন কার্বন নিঃসরণ করে ৫ নম্বর অবস্থানে আসছে ফিলিপাইন।
এছাড়া উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মধ্যে ১৮৪ টন কার্বন নিঃসরণ করে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করেছে জাপান। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কোরিয়া। দেশটি কার্বন নিঃসরণ করে ৭৯ টন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) রিপোর্ট উঠে আসছে, সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যান, তার অর্ধেকই গাড়ির আরোহী নন। তাদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই আসলে পায়ে-হাঁটা পথচারী, কিংবা সাইকেল বা মোটরবাইকের আরোহী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানেও পথ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে এ পদাতিক বা বাইক-সাইকেল আরোহীর সংখ্যাই অর্ধেক।
সড়ক কাউন্সিলের সদস্য ও নিরাপত্তা সড়ক চাইয়ের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের মধ্যে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনা কমেনি। গত ছয় মাসে দুই হাজারের ওপরে মানুষের প্রাণ ঝরেছে মৃত্যু সড়কে হয়েছে। এর মূল কারণ, সড়ক আইন কেউই মানে না।
বেশি আয়ের প্রবণতায় অধিকাংশ চালক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো গাড়ি চালায়। শৃঙ্খলা না থাকায় প্রতিনিয়ত সড়কে প্রাণ যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সঠিক বিচার পায় না। তদন্তের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটিতেও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ লোক থাকে না। সে কারণে সবকিছু অন্ধকারে থেকেই যায়। সড়ক নিয়ে অধিকাংশ মানুষই মনগড়া কথা বলে। এটা থেকে উত্তরণের জন্য বেপরোয়া চালককে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
Leave a Reply