মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৪ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট: চার দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজ কার্যালয়ের শাপলা হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন তিনি। রোববার (৩ মার্চ) দুপুরে এ সম্মেলন শুরুর কথা রয়েছে।
শনিবার (২ মার্চ) দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন এ তথ্য জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) এসিআর প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২০১৯ সালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে। এ ছাড়া ইউএনওদের মাধ্যমেই কাজ করতে হয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের। তাঁদের এই কার্যক্রম শক্তিশালী করতে এবার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারকি করার কথা। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগ কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। ডিসি ও ইউএনওদের অধীনেই কাজ করতে হয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাদের। ২০১৯ সালে গোপালগঞ্জ জেলার তৎকালীন ডিসির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনওদের মাধ্যমে পিআইওর এসিআর প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
এবার নিম্ন পদে জনবল বৃদ্ধি করা হলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ আরো সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ইউএনওরা।
একাধিক পিআইও কালের কণ্ঠকে বলেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের এসিআর প্রদানের বিষয়টি জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার পরিবর্তে ইউএনওদের প্রদানের সিদ্ধান্তের ফলে বিভাগীয় কার্যক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।
ডিসি সম্মেলন সামনে রেখে এ বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এই প্রস্তাবসহ ৩৫৬টি প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা। গত বছর এই প্রস্তাবের সংখ্যা ছিল ২৪৫।
একই সঙ্গে ডিসিরা প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক বিভিন্ন দাবিদাওয়ার বাঁধা ছকের বাইরে কাজ করতে গিয়ে যেসব অসুবিধা ও সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন সেসবও তুলে ধরেছেন। প্রতিবছর বেশির ভাগ প্রস্তাব থাকে ডিসি ও ইউএনওদের ক্ষমতা বা দায়িত্বের পরিধি বাড়ানো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি সংক্রান্ত। এবারও প্রস্তাব বৃদ্ধির সঙ্গে ক্ষমতার পরিধি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ বেশি এসেছে। অবশ্য প্রতিবছরই ঘুরেফিরে অতীতে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোই তুলে ধরেন তাঁরা। কারণ সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
তবে এবারের সম্মেলন নতুন মাত্রা পেতে চলেছে, প্রথমবারের মতো সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিবরা তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন ও পরামর্শ দেবেন। এ জন্য সম্মেলনের প্রথম দিন আজ রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘উন্নয়নে মাঠ প্রশাসন’ শীর্ষক এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে চার দিনব্যাপী এই ডিসি সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন এবং ভাষণ দেবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাঠ প্রশাসন সম্পৃক্ত বিষয়াদি নিয়ে মুক্ত আলোচনা হবে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের। প্রথম কার্য অধিবেশন হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সম্পর্কে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। এবারের ডিসি সম্মেলনে মোট ৩০টি অধিবেশন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দিন রয়েছে সাতটি, দ্বিতীয় দিন ৯টি, তৃতীয় দিন সতটি এবং চতুর্থ দিন সাতটি অধিবেশন।
ডিসিদের বিভিন্ন সুপারিশ
ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলার ডিসি উপজেলা পর্যায়ে ত্রাণ গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন। কারণ জরুরি দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী দ্রুত বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে কোনো ত্রাণ গুদাম নেই। এ জন্য ত্রাণসামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণ ও বিতরণ কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে বলে তাঁরা প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে ত্রাণ গুদাম-কাম-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন মুন্সীগঞ্জের ডিসি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে জনবল বৃদ্ধির প্রস্তাবও ঢাকা জেলার ডিসি দিয়েছেন। ভিজিএফ কর্মসূচিতে কার্ডপ্রতি ২০ কেজি চাল প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ডিসি। তিনি বলেছেন, বর্তমান দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় পরিবারপ্রতি ২০ কেজি চাল প্রদান করা প্রয়োজন। এতে অতিদরিদ্র পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং এ কর্মসূচির গুরুত্ব বাড়বে। বর্তমানে ভিজিএফ কর্মসূচিতে দুই ঈদে কার্ডপ্রতি ১০ কেজি চাল প্রদান করা হয়, উৎসব বিবেচনায় যা একটি পরিবারের জন্য অপ্রতুল। ফেনী জেলার ডিসি জিআর চাল বরাদ্দের জন্য বৃদ্ধাশ্রম, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র, কাব/স্কাউট সমাবেশ ইত্যাদি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। নীতিমালায় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এতিমখানায় লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের মতো জিআর চাল প্রদান করা যাবে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির অসচ্ছল পরিবারকে নগদ সহায়তা ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব এসেছে। সাতক্ষীরা জেলায় পর্যাপ্তসংখ্যক রেসকিউ বোট প্রদান করতে বলেছেন এ জেলার ডিসি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য রেসকিউ বোট চাওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া নতুন সড়ক পরিবহন আইনের আওতায় মালিকদের আনার প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। কারণ মালিকরা শ্রমিকদের নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার টার্গেট দিয়ে গাড়ি চালাতে দেন। ফলে জমা-খরচ তোলা এবং অধিক লাভের আশায় চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। সে কারণে মালিকদেরও জরিমানার আওতায় আনার প্রস্তাব করেছেন একজন ডিসি। এ ছাড়া সড়কে চাঁদাবাজি ও দুর্ঘটনা রোধে সড়ক আইনের দ্রুত বাস্তবায় চান ডিসিরা।
এ ছাড়া এবারের সম্মেলনে প্রধান আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ রোধ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদার করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার, ই-গভর্ন্যান্স, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় করা।
ভালো কাজের স্বীকৃতি চান ডিসিরা
একাধিক ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, এ সম্মেলনে তাঁরা যেসব সুপারিশ তুলে ধরবেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভালো কাজে স্বীকৃতি দেওয়া। তাঁরা বলেন, মাঠ পর্যায়ে কোনো কর্মকর্তা ভালো ভূমিকা রাখার পর সরকারের স্বীকৃতি মিললে তাঁরা আরো উৎসাহ নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু এমন কোনো প্রথা না থাকায় ভালো কাজে প্রতিযোগিতা কম দেখা যায়। অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে চান না। প্রশাসন ছাড়া অন্য প্রায় সব ক্যাডার কর্মকর্তাকে ভালো কাজে স্বীকৃতি দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেমন—পুলিশে ভালো কাজে পিপিএমসহ নানা ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সবচেয়ে বেশি প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের
এবার সবচেয়ে বেশি প্রস্তাব এসেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিষয়ে। এই বিভাগের মোট ২২টি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন ডিসিরা। এসব বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। গতকাল শনিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদসচিব মাহবুব হোসেন বলেন, গত বছর মোট ২১২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি, অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল এ রকম সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৫২টি, যার বাস্তবায়নের হার ৮৯ শতাংশ। তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের (মধ্যমেয়াদি) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ৯০টি। এগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নের হার ৫৯ শতাংশ। আর পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের (দীর্ঘমেয়াদি) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ৭০টি, এখন পর্যন্ত যার বাস্তবায়নের হার ৪৫ শতাংশ। মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, বাস্তবায়নের এই হারে তাঁরা সন্তুষ্ট। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাকি সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সম্মেলনের বাজেটের বিষয়ে এই মুহূর্তে জানাতে পারছি না। তবে সর্বনিম্ন খরচে আমরা সম্মেলন অনুষ্ঠান করি।’
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের পর এটিই প্রথম ডিসি সম্মেলন। ফলে এবারের সম্মেলনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে বিষয়ে দিকনির্দেশনার বিষয় আছে।
Leave a Reply