শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৮ পূর্বাহ্ন
রিয়াজ মাহামুদ আজিম॥
গণমাধ্যমকে বাদ দিয়েই আয়োজন হলো শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্ধশত বছর পূর্তিতে সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান। নাম মাত্র দুটি কয়েকটি জাতীয় দৈনিক এবং কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন পেলেও বাদ পড়েছে আঞ্চলিক পত্রিকার সাংবাদিকরা। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের অন্যতম সংগঠন প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটি ও মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবকেও মুল্যায়ন করেনি আয়োজকরা। এ নিয়ে সাংবাদিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছেন। তাছাড়া যাদের কঠোর পরিশ্রম ও পরিচর্যায় অর্ধশত বছরের এই হাসপাতালটি স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীরাও অপমানিত হয়েছে আয়োজক কর্তৃক। দীর্ঘদিন তাদের দিয়ে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করালেও ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ অনুষ্ঠানে গ্রহন করা হয়নি তাদেরকেও। নিচু শ্রেণির কর্মচারী হওয়ায় তাদের অবহেলা করে আভিজাত্যের চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে হাসপাতাল ও কলেজের কর্মচারীদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও চাকুরীর স্বার্থে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
অবশ্য সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অবমুল্যায়ন করে বিলাসবহুল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ অনুষ্ঠানের আয়োজনের পেছনে মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ, হাসপাতাল পরিচালক, স্বাচিপ ও বিএমএ’র কতিপয় নেতাকেই দায়ি করা হচ্ছে। তাদের অনিচ্ছার কারনেই সাংবাদিক এমনকি কর্মচারীদের অনুষ্ঠানের কোন পর্বে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত হীনমানসিকতার প্রমান এবং সরকারের উন্নয়ন প্রচারনায় বাঁধা সৃষ্টির একটি কৌশলমাত্র অভিযোগ করা হয়েছে। জানাগেছে, আগামী ২০ নভেম্বর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্ধশত বছর পূর্তি হবে। সে লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ অনুষ্ঠানের। যে অনুষ্ঠানে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা শেবাচিমের সাবেক শিক্ষার্থী নামিদামী দেশবরেন্য চিকিৎসকরা অংশগ্রহন করেছে। তাদের অংশগ্রহনে মহা মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে শেবাচিম ক্যাম্পাস। তার মধ্যেও শূণ্যতা বিরাজ করছে অনুষ্ঠানে। আয়োজকদের কিছু কিছু ভুল প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কের মধ্যে নিয়ে এসেছে বিলাসবহুল এই আয়োজনকে। মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্টরা জানায়, শেবাচিমে সুবর্ণ জয়ন্তী’র যে আয়োজন করা হয়েছে ইতিপূর্বে তা দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও হয়নি। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের প্রচারে যাদের প্রধান ভূমিকায় থাকার কথা সেই গণমাধ্যম ব্যক্তিরাই নেই আয়োজনে।
যাদের লেখুনি আর প্রচারের মাধ্যমে সাধারণ মহলে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব তাদেরকে বাদ দিয়েই আয়োজন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠানের। এতে করে বৃহৎ এই আয়োজনের সার্থকতা নিয়েও শেষ পর্যন্ত নানান প্রশ্নের জট বেঁধেছে স্বয়ং মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক এবং সাধারণ কর্মচারী মহলেও। বড় কোন কিছুর আড়াল করতেই সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে আয়োজকরা ‘সুবর্ণ জয়ন্তীর’ এই আয়োজন করেছে কিনা সেটিও এখন সর্বমহলে আলোচিত হচ্ছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কোন কিছুর প্রয়োজন হলেই সাংবাদিকদের স্মরনাপন্ন হচ্ছেন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেমনটি করেছেন সুবর্ণ জয়ন্তী নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। নিজেদের আয়োজনের প্রচার করতে সাংবাদিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ সহ অন্যান্য আয়োজকরা।
ওই সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশন মিডিয়ার বহু সাংবাদিক অংশ নেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন এবং সুবর্ণ জয়ন্তী’র স্বচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে স্থানীয় পত্রিকাগুলোতেই। তাদের এমন বিলাসবহুল আয়োজন পৌছে দিয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। কিন্তু মুল পর্বে এসে সেই আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোকেই এড়িয়ে গেলেন আয়োজকরা। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের মিডিয়া কভারেজের বিষয়টিও প্রশ্নের সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। কেননা সংবাদ সংগ্রহের কাছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হচ্ছে। তাই সরকারেরও যে কোন অনুষ্ঠানে মিডিয়া কভারেজের সার্থে সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে। শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজের আয়োজনেই ব্যতিক্রম চিত্র ফুটে ওঠে। তাদের এই আচরন ‘বড় হলেই, বড় মনের মানুষ হওয়া যায় না’ বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা প্রশ্নতুলে বলেন, সুবর্ণ জয়ন্তী’র যে আয়োজন করা হয়েছে তার পুরোটাই ওষুধ কোম্পানির চাঁদার উপর নির্ভরশীল হয়ে করতে হয়েছে।
অংশগ্রহনকারীদের কাছ থেকে যে অর্থ আদায় হয়েছে তার থেকে কয়েক গুন কম বাজেট রয়েছে। মোট কথায় কয়েক কোটি টাকার বাজেট রয়েছে সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানকে ঘিরে। কোম্পানির কাছ থেকে চাঁদাবাজির বিষয়টি এড়িয়ে যেতেই সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, নিজেদের পকেটের টাকায় নয়, ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চাঁদাবাজী করে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এটি ডাক্তারদের অনুষ্ঠান বলে প্রচার করা হলেও প্রস্তুতি সংক্রান্ত সকল কাজ কর্মচারীদের দিয়েই করিয়েছে। অথচ সেই কর্মচারীদের অনুষ্ঠানের মুল পর্ব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। কর্মচারীরা বলেন, তারা নিজেরাই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রন পেতে কলেজ অধ্যক্ষ ডা. ভাস্কর সাহা’র নিকট যান।
এসময় তাদের আশ্বস্তও করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে শুধুমাত্র অনুষ্ঠান শুরুর ৭ অক্টোবর সকালের নাস্তা এবং ৯ অক্টোবর শেষ দিকে এক বেলার খাবার দেয়ার প্রস্তাব দেয়। সে অনুযায়ী তাদের কার্ডও দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হন কর্মচারীরা। তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় কর্মচারীরা ফেরত দেন তাদের কার্ড। সেই সাথে গতকাল সকালে দেয়া তাদের নাস্তাও ফেলে দিয়েছেন কর্মচারীরা। কর্মচারীদের অভিযোগ কলেজ অধ্যক্ষ ডা. ভাস্কর সাহা, উপাধ্যক্ষ ডা. মাকসুমুল হক, বিএমএ বরিশাল জেলার সভাপতি ডা. ইসতিয়াক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান শাহীন, স্বাচিপ নেতা ডা. মাহবুব মোর্শেদ রানা ও ডা. পিযুশ কান্তি দাস এর পরামর্শের কারনেই সাংবাদিক এবং কর্মচারীদের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান থেকে দুরে রাখা হয়েছে। শেবাচিমের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের আমন্ত্রন না জানানোর বিষয়ে এক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল বিশ্বাস বলেন, মিডিয়া কি এবং মিডিয়া কভারেজ কি সেটা কলেজ অধ্যক্ষ ডা. ভাস্কর সাহা’র জানা নেই।
তার মত একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন লোককে কি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ’র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা আমাদের মাথায় আসছে না। তাছাড়া তার সাথে স্বাচিপ এবং বিএমএ’র যে নেতারা এমন সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত তারাও সরকারের উন্নয়ন এবং উন্নয়ন প্রচারনায় বাঁধা সৃষ্টির লক্ষ্যেই সাংবাদিকদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে আমার ধারনা। একজন সাংবাদকর্মী এবং সাংবাদিক নেতা হিসেবে বলবো গণমাধ্যমকে বাঁদ দিয়ে শেবাচিমের সুবর্ণ জয়ন্তী’র যে আয়োজন করা হয়েছে তা মোটেই ঠিক হয়নি। এর প্রতিবাদও জানান তিনি। অপরদিকে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীন সাংবাদিক এ্যাভোকেট এসএম ইকবাল বলেন, যে কোন অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতে সাংবাদিকরা যাবে, তাদের আমন্ত্রন জানানো হবে এটাইতো হওয়া উচিৎ। কিন্তু মেডিকেল কলেক কর্তৃপক্ষ যে কাজটি করেছে তা মোটেই ভালো করেনি। এটি তাদের ভুল এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শুধুমাত্র এই দু’জনই নয়, মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কর্মকান্ড নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন আরো অনেক সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
Leave a Reply