বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥( সহযোগিতায় ) এইচ এম হেলাল :
বরিশাল নগরীতে একটু সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে ঘুরলেই অনেক অপকর্ম-অপরাধের নানা নমুনা সহসাই চোখে পড়বে, জানা যাবে। কিছু দুর্নীতি আছে যা ঘটনাচক্রে প্রকাশ্যে চলে আসে, হয়ে উঠে আলোচিত। আবার কিছু থেকেই যায় লোকান্তরই । এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ষোলোআনাই রাজনীতিনির্ভর বলে অভিযোগ রয়েছে । যা টেকসই করতে সামনে আনা হয় ক্ষমতাসীন দলের ব্যানার। নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর এখন স্বর্ণযুগ। ফলে তার নামটি স্বার্থ লুটেরা ব্যবহার করা হচ্ছে এই নামটি। অবশ্য বছর খানেক আগে থেকেই এসব কর্মকান্ডের সূচনা পর্ব শোনা যাচ্ছিল।লক্ষীয়ন বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন সংশ্লিষ্ট থাকায় মিডিয়াকর্মীরা তোপের মুখে পড়ার ভয়ে থাকছেন নীরব । প্রশাসনিক মহলও প্রতিবাদে অগ্রসর হয় না রোষানলে পড়ার শংকায়। এবার নতুন করে পোর্ট রোডে আবিস্কৃত হল নবনির্বাচিত মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর নাম ব্যবহার করে অবৈধ ভবন নির্মানে এক বিস্ময়কর কাহিনী।
সরকারি খাস জমি দখল করে রড ব্যবহার না করেই গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল একাধিক ভবন। এ কাহিনী বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তবতায় তা স্বাভাবিক। শ্রমিকলীগ নামধারী একটি চক্র এই ঘটনার উদ্যোক্তা বিধায় এতদিন কোন হৈ-চৈ হয়নি। ঝুঁকির প্রশ্নে স্থানীয় কিছু নর-নারী এ নিয়ে গতকাল প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠলে বিষয়টি চলে ্আসে আলোচনায়। ভূমি কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটেও আসেন। কিন্তু স্বদম্ভে জানানো হয়- তারা মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর লোক। সাথে মহানগর এক আওয়ামী লীগ নেতা তাদের সমর্থন দেওয়ায় কারো পরোয়া করেন না। অবশ্য পরে ভবনটি নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশাসনিক এই পদক্ষেপ কতটুকু টিকবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
কারা এই শ্রমিকলীগ? এই পরিচয় জানতে গিয়ে পাওয়া গেল ঘাটের মাল লোড-আনলোড কাজে নিয়োজিত সালাম ও পাশ্ববর্তী আক্কাস-আব্বাস দুই সহোদর সেখানে গড়ে তুলেছে নিজস্ব একটি বাহিনী। আসলে এরা নবনির্বাচিত মেয়রের লোক কিনা সেই পোস্টমর্টেমটি পরেই করা যাক। আসি আসল ঘটনায়।
একটি আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক সম্পর্কে আমার স্নেহভাজন ওই যুবক গত রোববার রাতে একটি সংবাদ নিয়ে সেলফোনে আলাপচারিতার ফাঁকে প্রশ্ন রাখলেন, পোর্ট রোডে আজ কি হয়েছে জানেন? বেশ উৎসাহ বোধ করে জানতে চাইলাম, বিষয়টি সম্পর্কে। তার ভাষায়, কাজের তাগিদে তিনি সেখানে অবস্থানকালে এক বয়োবৃদ্ধ নারী ও তার স্বামী চিৎকার চেচামেচি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তার ঘর লাগোয়া একটি দ্বিতল ভবন ঝুঁকিপূর্ণভাবে নির্মাণ করায়।
ওই পত্রিকা সম্পাদক ঘটনাস্থলে অবস্থান নিয়ে জানলেন ও দেখলেন অনেক কিছুই। বলা যায়, তুলকালাম কান্ড। ওর কাছ থেকে যতদূর তথ্য-উপাত্ত পেলাম, তাতে কি বিস্ময়কর বিষয়, রড ব্যবহার বিহীন ৩০ হাত উচ্চতা সম্পন্ন একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে খাস জমিতে। নেই কারো কোনো বাধা। এটা কি সম্ভব যে রডবিহীন ভবন নির্মাণ করা যায়? কিন্তু বাস্তবতা বলে, ক্ষমতাসীনরা সবই পারে। শুধু রডবিহীন ভবন কেন, খাস জমিও দখল নিতে পারে। এই তথ্য জানার পর রোববার রাত ১১টার এক ফাঁকে ছোট ভাই সম্পর্কে এক সংবাদকর্মীকে নিয়ে গেলাম ঘটনাস্থল সেই পোর্ট রোড।যাকে বলা হয় বরিশালের নতুন সদর ঘাট ।
সেখানে উপস্থিত কয়েক ব্যক্তিকে দেখা মাত্র এ ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে দেখিয়ে দিলেন উত্তর পাশে বিশালাকায় জায়গা জুড়ে সরকারি খাস জমিতে যে যার মত বসবাস করছেন। এখন সেখানে ক্ষমতাসীন দলীয় সমর্থিতরা পাকা বাড়ি নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর মধ্যে আব্বাস ও আক্কাস নামের দুই সহোদর দ্বিতল যে ভবনটি নির্মাণ করছে তা অনেকটাই সাভারের রানা প্লাজার ন্যায়। এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কোন সময় তা ভেঙ্গে রানা প্লাজা ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বরিশালেও।
দেখা গেছে, কিছু দিন আগে শুরু ভবনটির এখনো নির্মাণ কাজ চলছে। কিভাবে শুরু হলো এই নির্মাণ, তা নিশ্চিত হতে কয়েকটি মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া গেল তাতে মিলল- ষোলআনাই ক্ষমতার প্রভাব। দুই সহোদর আব্বাস ও আক্কাস কারো কোনো প্রতিবাদ- তোয়াক্কা না করে হুরহুর করে ভবন নির্মাণ শুরু করে দেন। তাকে সহায়তা সহ পাহাড়া দেয় দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রিত ক্যাডার বাহিনী। বাড়িটি এমন জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে যার চতুর্পাশে রয়েছে টিনের ছাপড়া ঘর। এই ঘরের বাসিন্দারাও সরকারি জায়গা অনুমোদন ক্রমেই ব্যবহার করছেন। দ্বিতল ভবনটি নির্মাণে রড ব্যবহার না করায় সঙ্গত কারণে বিষয়টি বেমানান এবং অবৈধ বিষয়টি নিয়ে বির্তকের সুত্রপাত । এই প্রশ্নে দুপুরে যখন হৈ-চৈ পরিস্থিতি তখন সেখানে অবস্থানরত ওই তরুণ সম্পাদক আব্বাস-আক্কাসকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন তারা এ ধরনের উদ্যোগ নিলেন? অমনি হুমকি-ধামকি। একপর্যায়ে মহানগরের এক নেতার লোক হিসেবে দোহাই দিয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য জানান দিলেন। ওই নেতাই নাকি তাদের এই নির্মাণ কাজের আদেশ দিয়েছেন। তার চেয়েও দম্ভ করে বললেন, সদ্য নির্বাচিত মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ তাদের খুব কাছের লোক। সুতরাং চেপে যাওয়ার পরামর্শতো দিলেনও, এলাকা ছাড়তেও বললেন।
ওই সম্পাদকের ভাষার সাথে কয়েক ব্যক্তির সাথে আলোচনায় যে মিল পাওয়া গেল তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে- এ নিয়ে এলাকাবাসী কিছুটা সোচ্চার হলেও দুই ভাইয়ের ক্যাডার বাহিনী তাৎক্ষণিক সবাইকে দমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোন এক মাধ্যম এ খবর পৌছে যায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এ.ডি.এম) কাছে। তিনি তাৎক্ষণিক সদর এসিল্যান্ডকে ঘটনাস্থলে পাঠান। সরকারি এই কর্মকর্তা নিজেও সেখানে ভবন নির্মাণের অবকাঠামোগত গুণাগুন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায়। তাছাড়া খাস জমিতে আবার কি করে পাকা ভবন নির্মাণ? ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার সম্পন্ন এসিল্যান্ডের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয় ওই দুই সহোদর। একপর্যায়ে তারা মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর লোক হিসেবে বড়াই করে বেশি বাড়াবাড়ি না করার তাগাদা দিতে থাকেন হুমকির সুরে। এসময় দুই সহোদরকে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট সেলফোন দিয়ে ঘটনা জানিয়ে এসিল্যান্ডকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান করেন বলে অনুমান করা গেছে। তথ্যদাতার ভাষ্য মতে, মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সাথে এই টেলিআলাপ হলেও সম্ভবত তারা সাড়া দেয়নি বিতর্কে জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে।
এদিকে নাছোড়বান্দা এসিল্যান্ড তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। লোকজনের জটলা বাড়তে থাকলো। এর মধ্যে থেকে বেড়িয়ে আসলো আরো একটি কাহিনী। বড়ই নাটকীয়। বছর খানেক পূর্বে সেখানে নাজুত তিন তলা একটি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, তাও খাস জমিতে। ভবনটির মালিকের নাম সালাম। তিনিও শ্রমিকলীগ রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানা গেল। রাস্তার অপর প্রান্তে নির্মাণ সম্পন্ন ওই ভবনটি গত বছর গড়ে তোলা হয়। এখনো প্লাস্টার করা হয়নি। স্থানীয়রা যে ধারণা দিয়েছে, তাতে এ ভবনটি আরো নাজুত। সম্ভবত খাস জমিতে অত শক্তপোক্তভাবে ভবন নির্মাণে মালিকপক্ষ আগ্রহী হয়নি। মূলত গত বছর সাদিক আবদুল্লাহর বরিশাল রাজনীতিতে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের পরই এই জায়গাটি স্থায়ীভাবে দখল নেওয়ার কৌশল হিসেবে ভবন নির্মাণ সেই পরিকল্পনার একটি অংশ বলে ধারণা মিলল। জানা গেছে, ওই মুহূর্তে সেই সালামও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ কথা শোনা মাত্র এসিল্যান্ড তাকেও প্রশ্ন রেখেছিলেন, কিভাবে খাস জমিতে এই ভবন নির্মাণ করলেন? একই উত্তর- ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করায় একটু-আধটু সুবিধাতো নেবেনই। এক কথায় বলেই ফেললেন- তিনি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর লোক। তার রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত।
খোঁজ খবর নিয়ে যা অনুমান করা গেল- স্থানীয় এক মহানগর আওয়ামী লীগ নেতার সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য থাকায় তার প্রশ্রয় শ্রমিকলীগের ব্যানারে গোটা পোর্ট রোডে একটি বাহিনী গড়ে উঠেছে মূলত দখলবাজিতে। পাশাপাশি প্রভাব বিস্তার। এর মধ্যে সালাম মিয়ার দাপট একটু বেশি। তার তিন পুত্রের মধ্যে সেন্টু আছেন ক্যাডার তালিকার অগ্রভাগে। আব্বাস-আক্কাস দুই ভাইও প্রভাব বিস্তারে সমান্তরাল। এদের সমন্বয়েই এই বাহিনী। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির দাবি- সাদিক আবদুল্লাহর রাজনীতি করায় এদের দাপট এখন তুঙ্গে। তার উদাহরণ- এই ভবন নির্মাণ কাহিনীই যথেষ্ট। সাদিক আবদুল্লাহর বরিশাল রাজনীতিতে যখন প্রভাব শুরু তখন থেকেই সালামের উত্থান। সর্বশেষ গত বছর তৈরী করলেন খাস জমিতে ঝুঁকিপূর্ণ পাকা ভবন। আর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর আব্বাস-আক্কাসরা শুরু করেন দ্বিতল ভবন নির্মাণ।
মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর নাম ব্যবহার করে সেখানে যে অবৈধ নির্মাণ স্থাপনা তৈরী হয়েছে তা তিনি নিজেই জানেন কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি । তবে হাতরালেই খুঁজে পাওয়া যাবে আরো কিছু এ ধরনের নিদর্শন, এমন মন্তব্য শোনা গেল। কিন্তু আদৌতে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর নাম ব্যবহার করে যেসব অবৈধ কর্মকান্ড ঘটছে সে সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া পোর্ট রোডে থাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দাপটশীল যে নেতার নাম নিয়ে বড়াই করা হচ্ছে আসলেই কি তিনি এ ধরনের নির্মাণ কাজের আদেশ দিয়েছেন কিনা তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথা শোনা গেল। তবে সালাম-আব্বাস-আক্কাসরা যেভাবে মেয়রের দোহাই দিলেন তাতে মনে হল সাদিক আবদুল্লাহই তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্বভার নিয়েছেন। যদি তিনি এ ধরনের দায়িত্ব নিয়েই থাকেন তাহলে প্রশ্নতো উঠবেই।
একজন মেয়র অথবা ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতা হয়ে এ ধরনের কর্মকান্ড তিনি কিভাবে সমর্থন করেন? আবার এমনও হতে পারে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।হতে পারে তারা সাদিক আবদুল্লাহর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। সেই সাথে আলোচনায় আসা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা আক্কাস-সালামদের পেলে-পুষে রাখছেন ।সংগত কারনে সেই বলে তারা বলে বলিয়ান। সেখান থেকেই এই অনৈতিক সুযোগ নেওয়ার দুয়ার খুলে নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতার নাম সেখানে উচ্চারিত হয়েছে, আসলে তিনিও কতদূর এ বিষয়ে জানেন, তা নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ করছে। বলা বাহুল্য যে, সাদিক আবদুল্লাহর কানে অনেক অপকর্মের খবর পৌছানোর পর দ্রুত এ্যাকশন নিয়েছেন এমন উদাহরণও রয়েছে। বিপরীতে কিছু ঘটনা চেপেও গেছেন হয়তোবা রাজনৈতিক স্বার্থে-সুপারিশে।
তবে এ কথা সত্য যে, সাদিক আবদুল্লাহর নাম ব্যবহার করে নগরীতে নানা অপকর্ম এখনই যে শুরু হয়ে গেছে তার নমুনা অল্প-স্বল্প দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতি ভাল ঠেকছেনা । মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই অপকর্মের ধারাবাহিকতার গতিপথ কতদূর দীর্ঘায়িত হবে তা নিয়ে কথা থাকবেই। আছে শংকাও। যদিও সাদিক আবদুল্লাহ নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেন না। সমর্থন দেবে না রাজনৈতিক ব্যানারে অপকর্ম। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ভার এখনো গ্রহন করেননি , তার পূর্বে এতো অভিযোগ তাতেই এতো কথা ।এখন দেখা যাক সময় কি বলে ।
Leave a Reply