শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ অপরাহ্ন
সড়কপথে শোচনীয় মৃত্যু আর ভয়াবহ অরাজকতায় অতিষ্ঠ এ দেশের মানুষ। এই নৈরাজ্যের প্রতিবাদে সড়কে নেমে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে আমাদের শিশু-কিশোরেরা। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল, চাইলেই কেমন করে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়। দেখাল মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ—এদের মতো মানুষেরা প্রতিনিয়ত কেমন করে আইন অমান্য করছেন দেশে। এই নিয়ম ভাঙা ও বেআইনি কার্যকলাপ আমরা মেনে নিয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে। কিন্তু সবারই মনে ছিল অনির্বাণ কিছু প্রশ্ন: আইন কি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য? কেন যা ইচ্ছা তা করে পার পেয়ে যান এ দেশের ক্ষমতাধর মানুষেরা?
সড়কে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেই সাধারণ মানুষের সন্তানেরা আইনটা প্রয়োগ করেছে সবার জন্য। সাধারণ মানুষ ও শক্তিমান মানুষ—সবার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী মাহফুজুল হকের ভাষায়, আইনের শাসনের নগ্ন দেহে কাপড় পরিয়েছে তারা। এরা তাই মন জয় করে নিয়েছে এ দেশের ক্ষমতাহীন, ভাষাহীন, সুবিধাবঞ্চিত বিপুলসংখ্যক মানুষের। এভাবে তারা ক্ষমতায়নও করেছে এসব মানুষকে।
এদের কার্যকলাপে তাই মানুষ উচ্ছ্বসিত। নিজেরা দুর্ভোগ সহ্য করেও সমর্থন দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক, এ অবস্থা অনন্তকাল চলতে পারে না। শিশু-কিশোরদের দ্রুত স্কুলে ফেরা জরুরি। এই পরিস্থিতি সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে।
সরকার তাদের অনেক দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এসব দাবি পূরণে সময় লাগবে। সরকার তাই শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছে স্কুলে, গৃহে ফেরত যাওয়ার জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসব আশ্বাসের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আমার ধারণা, আশ্বাস রাখতে পারছে না সমাজের বহু মানুষই। কারণ কিছুদিন আগেই সবাই দেখেছে দেশের সরকারপ্রধান কোটা বিলোপের ঘোষণা দেওয়ার পর কীভাবে আন্দোলনকারীদের নির্বিচার হামলা ও মামলার শিকার হতে হয়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠন ও পুলিশের হাতে। বলপ্রয়োগে আন্দোলনে ভেঙে দেওয়ার পর সরকারপ্রধান বলেছিলেন, ‘অরাজকতা’ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর আগে এই সরকারের পক্ষ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ এমন আরও কিছু আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, যা আন্দোলন মিইয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া হয়েছে।
আমাদের তাই এখনকার সংকট হচ্ছে সরকারের প্রতি আস্থার অভাব, সড়কে নৈরাজ্য দূরীকরণে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ। এই আন্তরিকতা এখনই প্রমাণের সুযোগ সীমিত। যেমন সরকার ইচ্ছে করলে এখনই স্কুলগুলোর সামনে স্পিড ব্রেকার বা পথচারী পারাপর সেতু নির্মাণ করতে পারে না। চাইলে এখনই হত্যাকারী ড্রাইভারের শাস্তি দিতে পারে না।
তবে আন্দোলনকারী ও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ একটা দাবি করছেন, যা এখনই পূরণ সম্ভব—সেটা নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ। সড়ক পরিবহনের নৈরাজ্যে তাঁর কী ভূমিকা, তা দেশের সবাই জানেন। তিনি নিজের জীবনবৃত্তান্তেই এর প্রমাণ রেখেছেন। সড়কে হত্যাকাণ্ডের জন্য ফাঁসির আদেশ পাওয়া চালকের শাস্তির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সফল একটি আন্দোলন করেছেন, তা তিনি নির্দ্বিধায় লিখেছেন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর নিজের জীবনবৃত্তান্তে। সড়ক নৈরাজ্যের এই সর্দারের পদত্যাগ দাবি করছে ফেসবুকে আমার আওয়ামী লীগার বন্ধুদের অনেকেও। তবে আমার প্রস্তাবটা একটু ভিন্ন।
আমি জানি শাজাহান খানের পদত্যাগ বা পদচ্যুতি হলে উৎসাহ পেয়ে অনেকে সরকারের পদত্যাগের আন্দোলনে নামতে পারে, এই আশঙ্কা সরকারের মধ্যে রয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, বরখাস্ত হলে তিনি আরও নতুন উদ্যোগে পরিবহনশ্রমিক এমনকি পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে নৈরাজ্য শুরু করতে পারেন। এসব আশঙ্কা দূর করা যায় অন্যভাবে। আমার প্রস্তাব সরকার তাঁকে বরং সব শ্রমিক সংগঠনের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলুক। দর-কষাকষি শক্তির (শ্রমিক সংগঠন) নেতা এবং বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ (মন্ত্রী) একই ব্যক্তি হলে তাতে স্বার্থের সংঘাত হয়। এমনকি তা মন্ত্রীর শপথের লঙ্ঘনও হয়। তিনি মন্ত্রী হিসেবে অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। আবার শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি তাঁদের স্বার্থটাই বেশি দেখতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ডেকে বলতে পারেন, ‘আপনি হয় মন্ত্রী থাকেন বা সব শ্রমিক সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন।’
শাজাহান খান যদি শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁদের নৈরাজ্য করার শক্তি কিছুটা হলেও কমবে। তিনি বরং মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করলে বোঝা যাবে, এত দিন তাঁর কাছে শ্রমিকদের অরাজকতার স্বার্থটাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল। তাতে আর কিছু না হোক সরকার এক আত্মঘাতী মন্ত্রী থেকে রেহাই পাবে।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বা মন্ত্রিত্ব থেকে তাঁর পদচ্যুতি হলে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ অবশ্যই কমবে অনেকটা। হাতেনাতে একটা অর্জন হবে তাদের পরিশ্রম আর ত্যাগের। সরকার বলতে পারবে, ‘এই দেখ, করে দেখালাম একটা বড় কাজ।’ অনেক মানুষও ভাববে এবার হয়তো সড়কে নৈরাজ্য কমাতে সরকার তার আশ্বাসগুলো পূরণ করবে।
সমাধান শাজাহান খানেই। রাজপথে আমাদের সন্তানদের পুলিশ আর গুন্ডা দিয়ে না পিটিয়ে এটা উপলব্ধি করলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক।সুত্র, প্রথম আলো
Leave a Reply