শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৫ অপরাহ্ন
প্রিন্স তালুকদার (বাবুগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ ভোরের মৃদু কুয়াশাই বলে দিচ্ছে প্রকৃতিতে শীত খুব কাছেই। তাই শীতের মৌসুমে মৌসুমী আয়ের লক্ষে গ্রাম বাংলার চির চারিত খেজুর রস সংগ্রহে উদ্যোগী হয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার শতাধিক গাছি। বাঙালির শীতের দিনের অন্যতম আকর্ষন মধুরস খ্যাত খেজুর রসের, খেজুর গুড়ের তৈরি পিঠা-পায়েস। প্রাচীনকাল থেকে দখিনের জনপদ বরিশালের বাবুগঞ্জ এলাকার খেজুর রসের যশ ছিল। দিন বদলের সাথে এ এলাকায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি খেজুরের রস সংগ্রহ এবং গুড়-পাটালি তৈরির পদ্ধতিতে। শীত আসছে, তাই শীতের ভরা মৌসুমে রস সংগ্রহের জন্য শীতের আগমনী বার্তার শুরু থেকেই খেজুর রস সংগ্রহের প্রতিযোগীতায় মেতে উঠেছে গাছিরা। রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ পরিষ্কার ও পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গাছিরা। বেড়েছে অযতেœ আর অবহেলায় পড়ে থাকা সন্ধ্যা, সুগন্ধা আর আড়িয়াল খাঁ নদীর পলিবাহিত বাবুগঞ্জের খেজুর গাছের কদর। বরিশাল বিভাগীয় সদর দপ্তরের সবচেয়ে নিকটবর্তী উপজেলা বাবুগঞ্জ হওয়ায় প্রতিবছর শহর থেকে খেজুর রস পিপাসুরা আসেন রস সংগ্রহ করতে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলাকায় শীত একটু আগেভাগেই কড়া নাড়ছে, তবে এখনো শীতের তীব্রতা দেখা না মিললেও এর মধ্যে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন অনেকেই, কারন আগামী ৪ মাস খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে সুস্বাধু ও মানবদেহের জন্য উপকারী মিষ্টি রস। যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে খেজুর গাছ। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের খেতের আইলে, সড়ক ও বসতবাড়িতে থাকা খেজুর গাছের ডালপালা পাতা ও গাছের ছাল-বাকল ছেটে যাবতীয় কাজ পুরোদমে চালিয়ে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন গাছিরা। আর ১০/১৫ দিন পরই রস, গুড়, পাটালি পাওয়া যাবে এ অঞ্চলে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার চাঁদপাশা, রহমতপুর, কেদারপুর, দেহেরগতি, জাহাঙ্গীরনগর ও মাধবপাশা এলাকার খেতের আইলে, সড়কের পাশে ও বসতবাড়ির অধিকাংশ গাছই খেজুরের রস আহরনের জন্য প্রস্তুত করে ফেলেছেন গাছিরা। স্থানীয়রা জানান, শীতের আগমনী বার্তা দরজায় কড়া নাড়ছে, তাই প্রতি বছরের মতো এ বছরও গাছিরা এলাকার গাছ মালিকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা প্রথমে খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার করেন। এরপর শুরু হয় রস সংগ্রহ। চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির কলসে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য উকি দেয়ার আগেই গাছিরা রস ভর্তি মাটির কলস গাছ থেকে নামিয়ে পরে মাটির হাড়িতে কিংবা টিনের বড় হাড়িতে জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করে। বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে ইতিমধ্যে গাছিরা খেজুর গাছ তোলা চাছার কাজ শুরু করেছে। অল্প দিনের মধ্যে বাজারে নতুন খেজুর গুড়-পাটালি পাওয়া যাবে। গ্রামগুলোর মেঠো পথে চলার পথে এখন চোখে পড়ছে খেজুর গাছ তোলা-চাছার দৃশ্য। গাছিরা এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কিছু দিন পরই উপজেলার গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে গুড়-পাটালি তৈরির উৎসব। খেজুরের রস জ্বালিয়ে পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়বে। সকালে ও সন্ধ্যায় কাঁচা রস খেতে খুবই মজাদার। রসে ভেজা কাচি পোড়া পিঠার (চিতই পিঠা) স্বাদই আলাদা। নলেন, ঝোলা ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। নলেন গুড় পাটালির মধ্যে নারিকেল কোরা, তিল ভাজা মিশালে আরো সুস্বাদু লাগে। শীত মৌসুমে যা তৈরি হয় তা রীতিমতো কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। আবহমানকাল থেকে তাই বাংলায় নবান্নের উৎসব পালনে খেজুর গুড়ের কদর বেশি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা চাছার উপকরণ গাছি দা, দড়ি তৈরিসহ ভাঁড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে রয়েছে ব্যতিব্যস্ত। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের মোতাহার হোসেন বলেন, গাছ কাটা, রস জ্বালানো, গুড় ও পাটালি তৈরির উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার গত বছরের তুলনায় গুড়-পাটালির দাম দ্বিগুণ হবে। চাঁদপাশা ইউনিয়নের বকশিরচর গ্রামের গাছি মন্নান সরদার জানান, আমার বাড়িতে ৩টি খেজুরের গাছ সহ মোট ৫৬টি গাছ রস নামানোর জন্য তৈরী করেছি। আগামী ১০/১২দিন পর থেকে খেজুরের রস নামানোর জন্য উপযোগী হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, প্রতি গাছ চলতি মৌসুমে (কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত) ৪০০ টাকায় লীজ নেয়া হয়েছে গাছের মালিকদের কাছ থেকে। রহমতপুর ইউনিয়নের রাজকর গ্রামের গাছি শ্যামল চন্দ্র জানান, এবারে ৬৭টি গাছ লীজ নিয়েছি। লীজের টাকা বেশী হওয়ায় অনেক গাছি এবছর রস নামাবে না। কেদারপুর ইউনিয়নের চর ভুতেরদিয়া গ্রামের গাছি ফারুক নেগাবান বলেন, কয়েক বছর আগেও এলাকার প্রতিটি বাড়িতে, ক্ষেতের আইলের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেঁজুর গাছ। প্রতিবছর নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে নদীর তীরের সারি সারি খেজুরের গাছ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে, ঘরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহারের কারনে প্রায়ই খেজুর গাছ কেটে ফেলে মানুষ বনজ গাছ লাগাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে কমে গিয়ে খেঁজুর গাছ সংকটের জন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও চাহিদা অনুযায়ী রস পাওয়া যাবে না। আশার কথা শুনিয়ে পঞ্চায়েত এগ্রোর নির্বাহী পরিচালক ফয়ছাল আহম্মেদ বলেন, গত বছর বারি মাল্টা, বারি আম ও ভিয়েতনামের উন্নত নারিকেল চারা বাগানের চারপাশে দুই শতাধিক খেজুর চারা রোপন করিয়েছি। হয়তো আগামী আট দশ বছরের মধ্যে খেজুর রস সংগ্রহ করা যাবে। তিনি আরো বলেন, পুরাতন পরিত্যক্ত জমি, ক্ষেতের আইলে, বাড়ীর আশেপাশে সৌন্দর্যবর্ধক খেজুর, তাল চারা রোপন করা উচিৎ। চাঁদপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান সবুজ বলেন, দিন দিন খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেনীর গাছির অসাবধানতার দরুন গাছের মাথা মরে যাচ্ছে। প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত গাছি না থাকায় খেজুর গাছের রস বের করার সঠিক পদ্ধতি না জানার কারনে অনেক খেজুর গাছ অকালে মরে যাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার মোসাম্মাৎ মরিয়ম বলেন, এই এলাকার খেজুর রস খুব মিষ্টি মধুর, তাছাড়া রস থেকে খেজুরের পাটালি গুড় তৈরি করা হয়। যা দিয়ে এঅঞ্চলের জনপদের মানুষ বিভিন্ন পিঠা-পুলি তৈরি করে থাকেন। আমরা বেশি রস উৎপাদনের জন্য কৃষকদের খেজুরের গাছ লাগানোর জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে থাকি। তারা যত বেশি খেজুর গাছ লাগাবে তত বেশি রস উৎপাদন হবে। খেজুরের রস বিক্রি করে তারা লাভবান হতে পারবে। ইউএনডিপির ক্লাইমেট চেইঞ্জ কনফারেন্সে অংশ নেয়া বরিশাল প্রতিনিধি, বর্তমানে ব্যক্তিগত কাজে লন্ডনে অবস্থানরত আরিফুর রহমান মুঠোফোনে জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতন, জীববৈচিত্র সংরক্ষন প্রাকতিক পরিবেশ উন্নয়নে বন বিভাগের উদাশীনতা ও নজরদারী না থাকায় ঐতিহ্যবাহী পরিবেশবান্ধব খেজুর গাছ এখন বাবুগঞ্জ উপজেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে।
Leave a Reply