রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ন
পিরোজপুর প্রতিনিধি॥ কঁচা নদী, পিরোজপুরের দুঃখ। এই নদী পিরোজপুরকে শুধু উপজেলা নয়, বিভাগীয় শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। শুধু কি তাই, সড়ক পথে বিচ্ছিন্ন করেছিল পায়রা আর মোংলা সমুদ্রবন্দরকে। এখানেই শেষ নয়, বরিশাল থেকে বেনাপোল আর বাংলাবান্দা স্থলবন্দরও বিচ্ছিন্ন করেছে এই কঁচা।
সেই কঁচা নদীর ওপর স্বপ্নের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মিত হয়েছে। বঙ্গমাতা সেতু জুড়ে দিয়েছে পায়রা আর মোংলা সমুদ্রবন্দরকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার সেতুর উদ্বোধন করেন।
সেতুটি চালুর ফলে বরিশাল-পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনা, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যাতায়াতে সময় অনেক কমবে। এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এমনই প্রত্যাশা এই অঞ্চলের মানুষের। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল থেকে পায়রা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাবে। সেতু চালু হলে আশপাশে বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে। আর শিল্পকারখানা নির্মিত হলে স্থানীয় লোকজন সেখানে কাজ করতে পারবেন। কৃষিতে আরো গতি ফিরবে।
কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে
সেতু উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘কঁচা নদীতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুনন্নেছা মুজিব সেতু উদ্বোধনের পর দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগে আর কোনো বাধা থাকছে না। পিরোজপুরে প্রচুর পেয়ারা হয়। আমরা এখন থেকে ঢাকা বসেই খুব দ্রুত এই জেলার মজার পেয়ারা খেতে পারব। ’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, সারা বিশ্বে মন্দা দেখা দিয়েছে, আমাদের আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। দক্ষিণাঞ্চরের মানুষকে উৎপাদনমুখী হতে হবে। আমরা লবণাক্ত জমিতে ধান রোপণের জাতও উদ্ভাবন করেছি। আমরা আমাদের খাবার নিজেরাই উৎপাদন করব। এই অঞ্চলের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। ’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যই বলে দিচ্ছে সেতু শুধু যোগাযোগ নয় কৃষিক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখবে। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে বিশেষ করে পিরোজপুরে ভাসমান বাজার রয়েছে। সেখানকার কৃষি পণ্য দূর-দূরান্তের বাজারে পরিবহন কষ্টসাধ্য। ঢাকায় পচনশীল কৃষিপণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু পিরোজপুরের পেয়ারা নয়, কৃষিপণ্য সরাসরি ঢাকায় সড়কপথে পাঠানো সম্ভব হবে।
জাতীয় পার্টি-জেপি’র চেয়ারম্যান ও পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার বক্তব্যেও কৃষির বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘সেতু চালু হওয়ায় এখন থেকে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সহজে তাদের পণ্য পরিবহন করতে পারবেন। মধ্যসত্ত্বভোগীর প্রয়োজন হবে না। যারা ফসল ফলান, তারা আরো বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবেন। এতে করে কৃষিখাতের উন্নয়ন ঘটবে। মাছ ব্যবসায়ীরাও সেতুর সুফল পাবেন। ’
কচা নদীর বিড়ম্বনা থাকছে না
পিরোজপুরের ৭ উপজেলার সবগুলোই নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যে ৫ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদী। ইতোমধ্যে ৩ উপজেলা সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত হলেও এখনো বিচ্ছিন্ন আছে কাউখালী ও নেছারাবাদ (স্বরুপকাঠী) উপজেলা। নদীমাতৃক এ জেলায় সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় বাধা কঁচা নদী। নদীর দুই প্রান্তে ৩টি করে মোট ৬টি উপজেলা। নেছারাবাদে যেতে পার হতে হয় আরও এক নদী, নাম তার সন্ধ্যা।
জেলা সদর থেকে পিরোজপুরের অন্য ৪ উপজেলায় যেতে হলে ফেরি কিংবা খেয়ায় পার হতে হয় কঁচা নদী। বিভাগীয় শহরের সঙ্গে পিরোজপুর জেলা সদরের যোগাযোগেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কঁচা নদী। খুব জরুরী না হলে, ৪ উপজেলার মানুষ জেলা শহরে আসেন না বা জেলা শহর থেকেও কেউ অতি প্রয়োজন ছাড়া ওই ৪ উপজেলায় যাতায়াত করেন না। বরিশাল থেকে দেশের অন্যান্য প্রান্তে সরাসরি যাতায়াতে বড় বাধা কঁচা নদী।
এছাড়া, দক্ষিণাঞ্চল থেকে দেশের কোথাও পণ্য পরিবহন বেশ সময় সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। প্রশস্ত আর খরস্রোতা এ নদী পার হতে কমপক্ষে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। কখনো দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। তাই বরিশাল-পিরোজপুর-খুলনা কিংবা পাথরঘাটা-মঠবাড়িয়া-পিরোজপুর-খুলনা সড়কে যাতায়াত এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা।
এক ধাপ আগালো দক্ষিণাঞ্চল
সেতুটিকে ঘিরে দুই প্রান্তের জনসাধারণের মধ্যে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। এ সেতুটির মাধ্যমে রাজধানী থেকে বেনাপোল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। বরিশাল বিভাগীয় সদরের সঙ্গে খুলনা বিভাগীয় শহরের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন হবে। সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, পায়রা আর মোংলা সমুদ্রবন্দর সড়কপথে যুক্ত হচ্ছে। বাদ যাবে না বেনাপোল ও বাংলাবান্দা স্থলবন্দরও। সেতুটি সরাসরি সড়ক সংযুক্ত করবে নৌ আর স্থলবন্দরকে।
পাশাপাশি পদ্মা সেতুর সুবাদে দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য এ সেতুটি বিশেষ সুবিধা সৃষ্টি করবে। সড়ক পথে বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক এ মহাসড়কটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হলেও যান চলাচলে সময় লাগত চার ঘণ্টা। কচা নদীর বেকুটিয়া পয়েন্টে সেতুটি চালুর পর এ সময় এক ঘণ্টা কমে আসবে, থাকছে না ফেরির বিড়ম্বনা।
বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপক এবং বরিশাল সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম মাহমুদ সুমন বলেন, সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় কঁচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গমাতা সেতু চালুর ফলে খুলনা, মোংলা ও বাগেরহাট অঞ্চলের সঙ্গে পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগ আরো সহজতর হবে। এতে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনে গতি আসবে। সেতু উদ্বোধনের ফলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মধ্যে সড়কপথে যাতায়াত সময় প্রায় এক ঘণ্টা কমে যাবে।
পিরোজপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘এত দিন খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, বেনাপোল, চট্টগ্রামে বরিশাল থেকে সরাসরি বাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। এখন এই সেতুর ফলে পার্শ্ববর্তী সব এলাকার সঙ্গে বাস চলাচল চালু হবে। অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত সংযুক্ত হলো কঁচা নদীতে নির্মিত সেতুর মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই আমরা পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করছি, এবার বাড়তি সুবিধা যোগ করতে যাচ্ছে বঙ্গমাতা সেতু। ’
সেতুর ফলে যা হবে?
কঁচা নদীর প্রশস্ততা প্রায় এক কিলোমিটার হওয়ায় ফেরি পারাপারে প্রায় ৪৫ মিনিট লেগে যেত। বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি ও স্রোত বেড়ে গেলে আরো বেশি সময় লেগে যেত। এ ছাড়া ফেরিগুলো পুরোনো ও জরাজীর্ণ হওয়ায় প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে। বৈরী আবহাওয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকতো। ফলে পিরোজপুরের পাড়েরর মানুষকে বরিশাল শেরই বাংলা হাসপাতালে আসতে পারতো না। তারা সরাসরি চলে যেত খুলনাতে।
এছাড়া, নৌকায় করে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে না। ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে না শিক্ষার্থীদেরও। আর অন্য পাড়ের বাসিন্দাদের সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে কাজ করতে কিংবা হাট-বাজারে যেতে হয়রানির শিকার হতে হবে না। খরচ বাঁচবে। সরাসরি ট্রাক চলে যেতে পারবে ভারত সীমান্তে।
পিরোজপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও পৌর মেয়র মো. হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, এই সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান ও ব্যবসায়ীদের অনেক উন্নতি হবে। এছাড়া মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত সড়ক পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। ফেরীর আর সমস্যা থাকবে না।
আন্তর্জাতিক নৌপথ সচল থাকবে
কঁচা নদীর এই চ্যানেলটি আন্তর্জাতিক নৌপথ। যা ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রোটকাল চুক্তি অনুযায়ী এটি আন্তর্জাতিক নৌপথ। এ পথ দিয়ে পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশ হয়ে আসাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে। এ ছাড়া মোংলা বন্দর ও খুলনা থেকে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যবাহী বড় বড় নৌযান ও জ্বালানিবাহী অয়েল ট্যাংকার চলাচলেরও নৌপথ এটি।
বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপক এবং বরিশাল সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম মাহমুদ সুমন বলেন, যে কারণে সেতুটি নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স পানির স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে ১৮ মিটার রাখা হয়েছে। অপরদিকে গাবখান চ্যানেলটিও ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক নৌপথ। এই দুটি চ্যালেন যাতে সচল থাকে সেই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নকশা অনুযায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
Leave a Reply