সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ অপরাহ্ন
এইচ,এম হেলাল॥ মাদকের আগ্রাসনে আজ দেশের যুব সমাজ ধ্বংসের পথে। অনেক পরিবার হচ্ছে নিঃস্ব। আর এই মরণ নেশা ইয়াবার ছোবল থেকে কাজ করে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের অভিযানে একের পর এক ইয়াবার চালান আটক হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-পথকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারীরা। আর এ মাদকের বিষ ছড়িয়ে পড়ছে বরিশাল সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে।
এ থেকে পরিত্রান পেতে হলে পুলিশের পাশাপাশি সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, গণমাধ্যম, সাংবাদিক, সুশীল সমাজকে একত্রিত হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার)। সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার অভিযানে প্রায় ১ কোটি টাকার ইয়াবাসহ দুই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গাজী মাকসুদুল আলম নান্টু ও ইমদাদুল হক রজন কাজীকে গ্রেফতার করা হয়। নান্টু নগরীর বিএম কলেজ ও কাউনিয়া এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের একজন।
এর পূর্বে গত ৮ আগস্ট ২ হাজার ১শ’ ৪৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুই মাদক কারবারীকে গ্রেফতার করেছে কাউনিয়া থানা পুলিশ। ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পশ্চিম কাউনিয়া খালপাড় সড়ক এলাকা থেকে মোঃ রফিকুল ইসলাম সরদার (৪৯)কে ৫শ’ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সহ আটক করা হয়।
পরবর্তীতে আটককৃত রফিকুলের স্বিকারোক্তিতে নগরীর রুপাতলী এলাকার ডাক্তার মমিন সড়কে জাহানারা মঞ্জিলে রফিকের ভাড়াটিয়া বাসা থেকে তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম (৩৮) কে আটক করা হয়। এ সময় ওই বাসা থেকে আরো ১ হাজার ৬শ’ ৪৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে পুলিশ। সম্প্রতি কোস্টগার্ড কুয়াকাটা সংলগ্ন সমুদ্র থেকে পাঁচ লাখ পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে।
এসময় জিম্মি হিসাবে থাকা ১৩ জেলেকে উদ্ধার করা হয়। টেকনাফের গভীর সমুদ্র থেকে এই ইয়াবার চালান ট্রলারে উঠানো হয় বলে জানিয়েছেন আটক মাদক কারবারিরা। জানা যায়, কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে মাছ ধরার ট্রলারে করে ইয়াবার চালান সরাসরি নেওয়া হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল পটুয়াখালী, ভোলাসহ আশপাশের উপকূলীয় জেলায়। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে সড়কপথে বিভিন্ন জেলায় পাচার করা হচ্ছে ইয়াবা।
বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে সহজে ইয়াবার চালান পৌঁছাতে এখন নদী পথকেই প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে সহজেই ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে ২/১টি বড় চালান আটক হলেও এ চক্রটিকে কোনো ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ভোলা কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের লে. কমান্ডার এম নাজিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, মাদক কারবারিরা সমুদ্রের এই রুটকে নিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করে মাদক পাচার শুরু করছে। এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ১ এপ্রিল বরিশাল নদীবন্দর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের তৃতীয় তলার কেবিন থেকে ৯ হাজার ৮শ পিস ইয়াবাসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ ঘটনায় প্রেস ব্রিফিংকালে তৎকালীন বিএমপি কমিশনার ও অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোশারফ হোসেন জানান, বর্তমানে বেশি মাদক নৌ পথেই প্রবেশ করছে। সড়ক পথে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের রুট পরিবর্তন করেছে।
কিন্তু নৌ পথে আমাদের টহল কম হওয়ায় এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল নদী বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় সহজেই মাদকের চালান ঢুকানো সম্ভব হচ্ছে। সাগর পথে কক্সবাজার থেকে মাছ ধরার ট্রলারে জেলেদের মাধ্যমে কুয়াকাটা, কলাপাড়া, মহিপুরের সাগর পাড়ে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
সেখান থেকে বরগুনা, কাউখালী, মঠবাড়িয়া, ভাণ্ডারিয়া, ঝালকাঠী, বরিশালসহ আশপাশের উপজেলার ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নদী পথে তাদের চালান বুঝে নেন। এই কাজে জড়িত বরিশালের বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা যায়, বরিশালে বেশ কয়েকজন ইয়াবার ডিলার রয়েছেন। এরমধ্যে বরিশাল শিল্প নগরী (বিসিক) এলাকায় বাবুল এবং পশ্চিম কাউনিয়া এলাকার রফিক ওরফে বাঁশ রফিক অন্যতম। তাদের রয়েছে একাধিক মাদকের সিন্ডিকেট।
আর এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে রয়েছে খাজা মোহন, সজিব-সজল, জাকির, রেমান, আদু, রাজু, লালচানসহ আরো কয়েকজন। ভাটারখাল এলাকার চিহ্নিত বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম লাবনী, মালেক ওরফে গাঁজা মালেক, রাজিব, স্বরোড এলাকায় নাছির, ইউনুস। বেলতলায় জুয়েল ওরফে ইলেকট্টিক জুয়েল, গোড়াচাঁদ দাস রোডে লাকী ওরফে সুন্দরী লাকী.লিজা ওরফে মনিরা। উদয়ন স্কুল লাগায়ো সিটি মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় মাদক বিক্রি করছে ব্রাউন কম্পাউন্ড ’র বাসিন্দা সান্টু। সদর রোডে চৌধুরী সরোয়ার বাবু।
সিএন্ডবি ১ নং পুল এলাকায় মিরাজ, গীর্জা মহল্লায় সমিতা, বিএম কলেজ এলাকায় মেহেদি ও তসলিম। ভাটিখানা ও ব্রাঞ্চ রোড এলাকায় রয়েছেন বেশ কয়েক জন মাদক ব্যবসায়ী। এদের মধ্যে রয়েছেন সাগর ওরফে তেল সাগর। এরবাইরে নগরীতে মাঠ পর্যায়ে রয়েছে শতাধিক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়া নথুল্লাবাদ বাস র্টামিনাল, গরিয়ার পাড়, কাশিপুর শাহপরান সড়কের ফেন্সি ছালাম,মহিনশেখ,কাশিপুরবাজার, রূপাতলি বাস টার্মিনাল মাদকের স্পট রয়েছে বলে জানা যায়।
ইতোমধ্যে পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে বেশ কয়েকজন রাঘব বোয়াল মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হলেও মাদক নির্মূল করা যাচ্ছেনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সাগর ও নদীতে এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় যে মাদক পাচার হচ্ছে এ বিষয়ে নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশকে আরো জোরদার অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার) বলেন, মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সাড়াশি অভিযান চলছে।
এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং, বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। তবে মাদক নির্মূল করতে হলে আগে জনগণকে সচেতন হতে হবে। পুলিশের পাশাপাশি জনগণের উদ্যোগ, শিক্ষক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংবাদকর্মী, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে চট্টগ্রাম থেকে লক্ষীপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা হয়ে বরিশালে মাদক প্রবেশ করছে।
শুধু অভিযান দিয়ে মাদক নির্মূল সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি এলাকা, পাড়া মহল্লায় এমনকি পরিবারের মধ্যেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই মাদক নির্মূল সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
Leave a Reply