বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ জেলা প্রশাসকদের ২৫টি বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও ডিসিদের শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় প্রকল্পই গ্রহণ করতে বলেছেন। গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে ৩ দিনব্যাপী বার্ষিক জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৩ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যেটা আমাদের এখনই প্রয়োজন শুধুমাত্র সেগুলোই গ্রহণ করতে চাই। কোভিড-১৯ কালীন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় সারা বিশ্ব এখন হিমশিম খাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশও অর্থনৈতিক মন্দার দেশ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই আমাদের যেন সেটা করতে না হয় সেজন্যই আমরা কৃচ্ছ্রতা সাধনের ঘোষণা দিয়েছি, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলেছি এবং এই ব্যাপারেও আপনারা সচেতন থাকবেন। তিনি বলেন, ডিসিদের বিবেচনা করতে হবে যখনই কোনো প্রকল্প নেয়া হয় সেটা ওই এলাকার জন্য কতটুকু কার্যকর। এতে মানুষ কতটুকু লাভবান হবে এবং অপচয় কতটুকু বন্ধ করা যায়, সেদিকে আপনাদের নজরদারি থাকা উচিত। জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আসার (ক্ষমতায়) পর আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এই যে জনমুখী বা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বা জনগণকে সেবা দেয়ার যে একটা আন্তরিকতা থাকা উচিত সে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিবর্তন আমি দেখেছি আপনাদের মাঝে।
আর সেটা যদি না হতো বাংলাদেশের উন্নয়নে যতটুকু কাজ আমরা করতে পেরেছি বা সফলতা পেয়েছি সেটা সম্ভব হতো না।
কারণ, আমরা জনপ্রতিনিধিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই ক্ষমতায় আসি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার জিএসএম জাফরুল্লাহ বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে এবং নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নাঈম মোহাম্মদ মারুফ খান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভিন তিবরিজি জেলা প্রশাসকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক উন্নয়নের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। ডিসিদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ২৫ দফা নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হবে। কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে; নিজেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; সরকারি অফিসসমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘ্নে যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে; সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হবে; এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে; গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি ও ঘর প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে; কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রসমূহ যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে; শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে; নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে; পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে; সরকারি দপ্তরসমূহের ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। নিজ নিজ জেলার সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরতে হবে; জনসাধারণের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে; আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করতে হবে; মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে; মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে।
নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সেজন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুবসমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে হবে; বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকলপণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে; বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, কৃত্রিম সঙ্কট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে; সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে; নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্লুইসগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে; বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় তালগাছ রোপণ করতে হবে; পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে; জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার, বিপণন এবং ব্রান্ডিং করতে হবে; জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সেবার মনোভাব নিয়ে যেন সরকারি দপ্তরগুলো পরিচালিত হয়, সে লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে বরিশাল জেলায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’র আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে জনবল নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন, নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণসহ জেলা প্রশাসকদের মাঠপর্যায়ে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রেখে দায়িত্ব পালন, দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখা, আশ্রয়ণ প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে যাতে কোনো গৃহহীন ব্যক্তি না থাকে তা নিশ্চিতকরণ এবং কল্যাণকর মাঠ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা প্রশাসকগণকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধিবেশনে সরকারি দাবি আদায় আইন, ১৯১৩ যুগোপযোগীকরণ ও ম্যানুয়াল প্রস্তুতকরণ বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীর সন্তানের জন্য প্রদেয় ‘শিক্ষা সহায়ক ভাতা’ যুগোপযোগীকরণ বিষয়ে আলোচনা হয়।
এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত সমন্বয় কমিটি গঠন, কৃষিঋণ বিতরণ কার্যক্রম মনিটরিং-এর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, দুর্যোগ/ক্রান্তিকালে সরকারের প্রণোদনা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবীক্ষণ জোরদারকরণ, যে সকল উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র নেই সেই সকল উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র স্থাপন এবং উন্নয়ন প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যবহারযোগ্য করার লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই প্রয়োজনীয় জনবল সংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। তৃতীয় অধিবেশনে স্ব স্ব ব্যবস্থাপনায় সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৪ ঘণ্টার জন্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষা চ্যানেল চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ, হাওর অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি সংক্রান্ত ফ্লেক্সিবেল ক্যালেন্ডার প্রণয়ন, বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন, ‘উপজেলা শিক্ষা অফিসার’ পদবীর পরিবর্তে ‘উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার’ করা, ‘জেলা শিক্ষা অফিসার’ পদবীর পরিবর্তে ‘জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার’ করা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন ও সড়ক পরিবহন আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা, অঞ্চলভেদে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা, প্রয়োজন সাপেক্ষে জেলাসমূহে কৃষি ডিপ্লোমা কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
Leave a Reply