শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৬ অপরাহ্ন
শামীম আহমেদ ॥ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় মন্ডপে মন্ডপে বাদ্যযন্ত্র, ঢাক-ঢোলের শব্দ আর ধুপের গন্ধে মেতে ওঠেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।তাই দুর্গা পূজাকে সামনে রেখে শেষ সময়ে মহাব্যস্ত সময় পার করছেন বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বেশি পূজা আয়োজন করা আগৈলঝাড়া উপজেলার বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগররা।
একসময় বরিশালে ঢাক তৈরির প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন গোটা জেলাড়–ড়ে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান টিকে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কারিগররা ঐতিহ্য ধরে রেখে তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
বাদ্যযন্ত্র তৈরির বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, গত একমাস ধরে ঢাক ও ঢোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কারিগররা। তাদের দম ফেলারও সময় নেই।
কাঠের খুটখাট শব্দে মুখর দোকানগুলো। ঢাক-ঢোলের জন্য তৈরি করা খোল রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত অধিকাংশ কারিগররা। তারা (কারিগর) জানান, পূজাতে ঢাক-ঢোলের বাজনা অপরিহার্য।
কারণ হিন্দুশাস্ত্রেও এর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তাই ঢাক-ঢোল ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায়না। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা কমে যাচ্ছে। কাঠ, চামড়াসহ ঢাক-ঢোল তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ হয়না।
আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের ঢাক তৈরির কারিগর শ্যামল দাস (৫৭) বলেন, বংশ পরম্পরায় দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে আমি এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছি।
আগেরদিনের মতো এখন আর ঢাক ও ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাক-ঢোল, খোল ও তবলা। তবে পূজা উপলক্ষে ঢাক-ঢোলের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, অনেক কষ্ট করে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরে রেখেছি। এ ব্যবসায় এখন যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
শ্যামল দাস বলেন, বড় আকারের প্রতিটি ঢাক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি সাত থেকে আট হাজার টাকা। ঢোল বড়টি ছয় হাজার টাকা, ছোট ও মাঝারি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা এবং প্রতিটি খোল সাড়ে তিন হাজার টাকা দামে বিক্রি করা হয়। শ্যামল আরও বলেন, দুর্গা পূজাকে সামনে রেখে কাজের চাঁপ বৃদ্ধি পেলেও অধিকংশই পুরনো ঢাক কিংবা ঢোল মেরামতের কাজ।
গৌরনদী পৌর এলাকার ঐতিহ্যবাহী টরকী বন্দরে বাদ্য ভবন নামের প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাস।
বলেন, স্বর্গীয় পিতা কার্তিক চন্দ্র দাসের পেশাকে আমি আঁকড়ে ধরে রেখেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ঢাক-ঢোল, তবলা, হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের নতুন বাদ্য বিক্রি ও পুরাতন বাদ্য মেরামতসহ সকল বাদ্যের চামড়া বিক্রি করা হয়। তিনি আরও বলেন, পাঁচজন শ্রমিক নিয়ে আমি বারোমাসই এ কাজ করে থাকি।
একাধিক কারিগর জানান, গান বাজনা, যাত্রানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কম হওয়ায় দিন দিন ঢোলের চাহিদাও কমে যাচ্ছে। তাই সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পরেছে।
যে কারণে এ কাজে কারিগররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তারা আরও জানান, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন আর ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পূজা-পার্বনে এখনও ঢাক-ঢোলের কদর রয়েছে। পূজার আরতিতে ঢোলের এখনও কোনো বিকল্প নেই। তাই বছরের এ সময়টাতে ব্যস্ত সময় পার করেন ঢুলি থেকে শুরু করে ঢোল ও খোল তৈরির কারিগররা।
বাদ্যযন্ত্র অনুরাগী আগৈলঝাড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তপন বসু বলেন, আমাদের প্রায় সবারই পূজার সানাইয়ে মন কেমন করে ওঠে। শুধু সানাই নয়, জোড়া কাঠিতে ঢাক কিংবা কাসরের উপর একটানা একটি কাঠির তিনটি শব্দ-সুরের যে মুর্ছনা সৃষ্টি করে এসেছে তা বাঙালির একান্ত নিজের সুর।
এ সুরের ইন্দ্রজাল ছিড়ে আমাদের বাঙালির গানে প্রবেশ করেছে গিটার, প্যাডড্রাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। যার প্রভাবে আমাদের ঢাক-ঢোল এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তিনি আরও বলেন, বিচিত্র পেশার ভিড়ে দেশজ বাদ্যযন্ত্র তৈরির পেশায় অর্থের প্রাচুর্য না থাকায় মানুষ বংশানুক্রমিক এসব পেশা পরিবর্তন করে নতুন উপার্জনের পথ ধরেছে। ফলে বাদ্যযন্ত্র তৈরির ঘরগুলো কমে গেছে।
Leave a Reply