শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥ শুক্রবার রাতে ঘড়ির কাটা তখন সাড়ে ৯টা ছুই ছুই। বরিশাল নগরীর কালিবাড়ি সড়কে নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাস ভবনের সামনে অগণিত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভিড়ে ঠাসা। আগত সবার অপেক্ষা নেতার সাক্ষাৎ লাভ। এর ফাঁকে যে যার মত জটলা বেঁধে একেক স্থানে দাঁড়িয়ে নানা খোশগল্পে মশগুল। এই জটলা তৎসংলগ্ন রাখাল বাবুর পুকুর পাড় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। এসময় অধিকাংশের মুখে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে ভোটের দিনকার নানান কাহিনী।
জটলা ভেদ করে পথচারী ও মোটর যান নিয়ে এই সড়ক অতিক্রম করা সময় সাপেক্ষের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কালিবাড়ি সড়কের মধ্যভাগের মোড় ঘুরে রাখাল বাবুর পুকুর পাড়ের দিকে যেতেই একটি চায়ের দোকানের সামনে নেতা-কর্মীদের জটলায় সংবাদকর্মীদের একটি মোটরসাইকেল আটকা পড়ে যায়। এসময় কানে ভেসে আসে একটি ভোট কেন্দ্রে কিভাবে দলীয় মেয়র প্রার্থীর পক্ষে দেদারছে জাল ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে একে অপরের দক্ষতা জাহির করার পাশাপাশি দম্ভ। ফলশ্রুতিতে উৎসুক হয়ে চা পানের অজুহাতে সেখানে কিছু সময় দাঁড়ানোর পর শোনা গেল আরো কিছু চমকপ্রদ তথ্যাদি। কোন ওয়ার্ডে কিভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের পরাজয় ঘটেছে তার নেপথ্যে বিরোধী দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের সাথে গোপন সমঝোতার বিষয়টি। যেখানে টাকা ভাগাভাগির বিষয় নিহিত রয়েছে। সেই আলোচনায় উঠে আসে দুটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতারা কত টাকায় দলীয় প্রার্থীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিএনপি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে লাভবান হয়েছেন।
৮ জনের একটি জটলায় মূল আলোচনায় ছিল মহানগর শ্রমিকলীগ সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাসের ওপর ক্ষোভের জ্বালা। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাসুমের পক্ষের ক্ষুব্ধ দু’জন কর্মী জোরালো কণ্ঠে বললেন, ৯ নং ওয়ার্ডে যা ঘটেছে তাতে পরিমলকে দল থেকে বহিস্কার করা উচিত। অপর ৬জন একই কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বললেন, ভোটের দিন সকালের চিত্রপটের একটি কাহিনী। তাদের ভাষায়- পরিমল চন্দ্র দাস একটি কেন্দ্রে প্রবেশ করেই নৌকায় জাল ভোট দেয়ার তাগিদ দিয়ে বললেন, ঠেলাগাড়ির প্রয়োজন নেই। কিছু সময় পর তাকে নাকি দেখা যায় বিএনপি দলীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারুন অর রশিদের ঘুড়ি মার্কায় তার সমর্থকদের জাল ভোট দিতে সহায়তা করতে। এরপর বিভিন্ন কেন্দ্রে এই শ্রমিকলীগ নেতা একই ভঙ্গিমায় বিএনপি দলীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পক্ষে কাজ করেন কিছুটা কৌশলী ভূমিকায়। আলোচকদের দাবি, ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পরিমল চন্দ্র দাস বিরোধী দলের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এই টাকা শুধু তিনিই নয়, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগাভাগি করে নিয়ে ভোটের রাতেই “ঠেলাগাড়ি ঠেকাও” মিশন নেয়।
এই আলোচনার আকর্ষণে সংবাদকর্মীদের কান যখন সেদিকেই তখন অপর প্রান্তে দাঁড়ানো ৬ জনের অপর একটি গ্রুপ ভোট জালিয়াতির আরেকটি কাহিনী নিয়ে নিজেদের মধ্যেকার বাহাস করার আওয়াজ জোরেসোরে শোনা যাচ্ছিল। সে কাহিনী ২ নম্বর ওয়ার্ডের। সেখানে জাতীয় পার্টির মুরতজা আবেদীন কিভাবে জয়লাভ করলেন সেই আলোচনায় উঠে আসে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাদের টাকা ভাগাভাগির গোপনীয়তা। যুব বয়সী এক আলোচক সম্ভবত তিনি ওয়ার্ড আ’লীগের কোনো পদে রয়েছেন, তার বক্তব্য হচ্ছে- ভোটের রাতেই মুরতজা আবেদীন প্রশাসনসহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে কব্জায় নিয়ে নেয়। তাদের ভাষায়- তিন লাখ টাকায় ম্যানেজ হয়ে যায় এবং কৌশল নিয়েছিল ভোটের দিন কার কি ভূমিকা থাকবে। সেক্ষেত্রে শোনা গেল, ২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন জিয়া একাই সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ৪টি কেন্দ্রে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে নৌকায় সিল মারার পাশাপাশি মুরতজার সমর্থকদের জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়। পুলিশও নাকি মুরতজাকে সহায়তা করে। আলোচকদের দাবি- ঠেলাগাড়ি প্রতীকের প্রার্থী মাইনুল ইসলামকে ভোটের মাঠে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। এমনকি পুলিশ আওয়ামী লীগ নেতা মাইনুল ইসলামের সাথে অসৌজ্যমূলক আচরণ করে। ভোট কেন্দ্রে পর্যন্ত ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। যদিও মুরতজার ভোট ব্যাংক মাইনুল অপেক্ষা দ্বিগুণ। কিন্তু এবার সম্ভাবনা ছিল নৌকার পাশাপাশি মাইনুলও উতড়ে যাবে।
আলোচকদের একজন জোরকণ্ঠে বললেন, নির্বাচনী প্রচারকালে একটি সভায় আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ প্রত্যেক ওয়ার্ডের দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্কস্বরূপ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার পক্ষে যে পরিমান ভোট পরবে, প্রতিটি কেন্দ্রে ঠেলাগাড়ি প্রতীকও যেন সমসংখ্যক ভোট পান। নচেৎ ওয়ার্ড আ’লীগ নেতাদের জবাবদিহি করতে হবে। সাদিক আবদুল্লাহর সেই বক্তব্যের সূত্র টেনে ধরে একজন আলোচকের উক্তি ছিল, কোথায় টিকলো নেতার কথা? টাকার কাছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ বিক্রি হয়ে যাওয়ায় দলীয় কাউন্সিলরদের অনেকের পরাজয় সহসায় ত্বরান্বিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল নৌকায় বিপুল পরিমান ভোট কাস্ট করা হলে ভিনদলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষ নেওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যাবে।
আলোচকদের এই বক্তব্য অমূলক নয়। ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৭টি ওয়ার্ডে নির্বাচনে এবার ১৮জন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। অপর তিনটি ওয়ার্ডে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় আগে-ভাগেই নির্বাচিত হয়েছেন আ’লীগ দলীয় প্রার্থী। দলীয় অন্যরা পেরে ওঠেনি বিভাজনের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থীরা অর্থের টোপে দায়িত্বশীল নেতাদের বাগে নিতে সক্ষম হওয়ায়। অবশ্য অর্থনৈতিক লেনদেনের এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু শোনাই গেল।
তবে আধা ঘন্টা সেখানে দাঁড়িয়ে আলোচনার সার সংক্ষেপ অনুধাবনে সংবাদকর্মীরা একটি বদ্ধমূল ধারণা পেয়ে যায়- কি ঘটেছিল ভোটের দিন। জানা গেছে, এর রেশ ধরেই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ১১ নেতাকে শোকজ নোটিস দিয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগ। জবাব চেয়েছে দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের পরাজয়ে তাদের ভূমিকা কি ছিল? আলোচকরা ওয়ার্ড নিয়ে আলোচনার পর দলীয় মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কে কত জাল ভোট দিয়েছেন তা নিয়ে একপ্রকার বাকযুদ্ধ শুরু করে দেয়। জাহির করতে থাকে নিজস্ব ভোট দেওয়ার রেকর্ড। এসময় পথচারীদের অনেকেই এই আলাপ অল্প-স্বল্প শুনতে পেয়েই হাসতে হাসতে যেতে দেখা গেছে।
তাদের কারো কারো মন্তব্য ছিল- দলীয় নেতা-কর্মীরাই এভাবে যদি প্রকাশ্যে জাল ভোটের স্বীকারোক্তি দেয় তাহলে বিএনপির পক্ষ থেকে আর বলার দরকার হয় না। তাও আবার সদ্য নির্বাচিত দলীয় মেয়রের বাস ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই। খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল- এই সময়কালে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বাসায় ছিলেন না। তার অপেক্ষায় সড়কের ওপর দীর্ঘ জায়গা জুড়ে নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা দাঁড়িয়ে থাকার ফাঁকেই এই খোশগল্প থেকে বেফাঁস কথাবার্তায় চলে আসে ভোট কারচুপির নিজ স্বীকারোক্তি।
Leave a Reply