সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন
বরগুনা প্রতিনিধি॥ বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন শুনানিতে আদালত বলেছেন, একজন পুলিশ সুপার (এসপি) যদি বলেন, মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন; তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব হয়ে যায় পুলিশ সুপারের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার। যদি মিন্নি নিজের দোষ স্বীকারও করেন তাহলে তদন্তের স্বার্থে সেটা কি প্রকাশ করার বিষয়? আপনারা গ্রেপ্তারের আগেই পুলিশ লাইনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, তাহলে সে (মিন্নি) কতটুকু সত্য কথা বলতে পারবে? এইখানে (কোর্টে) অনেক আইনজীবী উপস্থিত রয়েছেন; যাদের জিজ্ঞাসা করলে বুঝবেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পর তাদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল?
আজ মঙ্গলবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন শুনানিকালে এসব মন্তব্য করেন।
এ সময় মিন্নির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও এম আমিন উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন।
দুপুর ২টা ৫ মিনিটের পর শুনানির শুরুতে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে পুলিশ লাইনে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ডেকে নিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরের দিন ১৭ জুলাই তাঁকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হয়। এর পরের দিন ১৮ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সুপার দাবি করেন, মিন্নি ঘটনায় জড়িত। এর পরের দিন ১৯ জুলাই মিন্নির কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। অর্থাৎ মিন্নির স্বীকারোক্তির আগেই পুলিশ সুপার সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন। মিন্নি আদালতে এ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে নির্যাতন করে পুলিশ এসব বক্তব্য আদায় করেছে।
এ সময় আদালত মিন্নির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পড়ে দেখেন।
এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী আদালতে বলেন, মাই লর্ড, এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। এ মামলায় ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মিন্নি ছাড়া আরো চারজন আসামি ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সবাই এ ঘটনার মূল হোতা হিসেবে মিন্নি জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। যেহেতু দোষ স্বীকারমূলক জবানবন্দি রয়েছে তাই জামিন দেওয়া ঠিক হবে না।
এ সময় আদালত বলেন, তদন্ত চলার সময়ে পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন করে বক্তব্য দেওয়া কতটুকু যুক্তিসংগত?
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কাইয়ুম ও রিফাত ফরাজী দোষ স্বীকার করে বলেছেন, মিন্নি এ মামলার মূল ষড়যন্ত্রকারী। এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ লাইনে নেওয়া হয়। এটা ছিল একটা নির্দয় হত্যাকাণ্ড।
এরপর আদালত বলেন, কোনো ঘটনার পর তদন্ত চলার সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্রিফিং করলে পাবলিক পারসেপশন কী হয়? একজন পুলিশ সুপার (এসপি) যদি বলেন, মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন। তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব হয়ে যায় পুলিশ সুপারের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার। যদি মিন্নি নিজের দোষ স্বীকারও করেন, তাহলে তদন্তের স্বার্থে সেটা কি প্রকাশ করার বিষয়?
এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, এটা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আদালত বলেন, আপনারা গ্রেপ্তারের আগেই পুলিশ লাইনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাহলে সে কতটুকু সত্যকথা বলতে পারবে?
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী হিসেবে ডেকে নেওয়া হয়েছে।
এ সময় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, এই কোর্টে অনেক আইনজীবী উপস্থিত রয়েছেন; যাদের জিজ্ঞাসা করলে বুঝবেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পর তাদের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল?
জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, পুলিশ তাঁকে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েছিল।
এ সময় আদালত বলেন, তদন্তকালে ব্রিফিং করলে তদন্তকে প্রভাবিত করে কি না, তাও দেখতে হবে।
তখন মিন্নির পক্ষে অপর আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম. আমিন উদ্দিন আদালতে বলেন, মিন্নি কলেজে পড়ুয়া একজন তরুণী। যেকোনো শর্তে জামিন চাই। আপনারা জামিন দিলে মিন্নি পালিয়ে যাবেন না। এমনকি তদন্তকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই।
এরপর আদালত আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে এক সপ্তাহের রুল জারি করেন। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ২৮ আগস্ট কেস ডকেট নিয়ে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বরগুনা পুলিশ সুপারকে মামলা তদন্ত চলার সময়ে মিন্নি দোষ স্বীকার করেছেন মর্মে মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দেওয়ায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলার রুলের ওপর পরবর্তী শুনানি ২৮ আগস্ট দিন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ৮ আগস্ট আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন আবেদন ফেরত দেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই দিন হাইকোর্ট বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন দেননি। জামিন আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল দিতে চাইলে মিন্নির আইনজীবীরা তাতে সম্মত হননি। পরে আদালত জামিন আবেদন ফেরত দেন।
এর আগে গত ৮ আগস্ট আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির জামিন আবেদন ফেরত দেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ওই দিন হাইকোর্ট বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে জামিন দেননি। জামিন আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল দিতে চাইলে মিন্নির আইনজীবীরা তাতে সম্মত হননি। পরে আদালত জামিন আবেদন ফেরত দেন।
এর আগে গত ৫ আগস্ট মিন্নির জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। গত ৩০ জুলাই মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
২২ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে প্রথমবার মিন্নির জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী মো. মাহবুবুল বারী আসলাম। ওই দিনই শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
পরদিন ২৩ জুলাই ‘মিস কেস’ দাখিল করে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামানের আদালতে ফের জামিনের আবেদন করেন মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। পরে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের নথি তলব করে ৩০ জুলাই জামিন শুনানির দিন ধার্য করেন।
সেদিন তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উভয়পক্ষের শুনানি চলতে থাকে। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন আদালত। তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির আদালতে উপস্থিত হলে এ হত্যাকাণ্ডে মিন্নির সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হয়। সবার উপস্থিতিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ল্যাপটপে হত্যাকাণ্ডের আগের ও পরের ভিডিও ফুটেজ দেখান। এ ছাড়া মিন্নির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিসহ হত্যার আগে ও পরে প্রধান আসামি নয়ন বন্ডসহ অন্যান্য আসামির সঙ্গে মিন্নির কললিস্টের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন। শুনানি শেষে মিন্নির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
গত ২৬ জুন বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে নিয়ে বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে ফেরার পথে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ একদল যুবক রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালায়। তারা ধারালো দা দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় মিন্নি হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন; কিন্তু তাদের থামানো যায়নি। খুনিরা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যায়। পরে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিফাতের মৃত্যু হয়।
এ হত্যার ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ পরের দিন সকালে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা সদর থানায় মামলা করেন। মিন্নি ছিলেন সেই মামলার এক নম্বর সাক্ষী। পরে ১৬ জুলাই রাতে এ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পরদিন বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর পরদিন ১৮ জুলাই বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া সব আসামি এবং মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কারণে সুস্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিন্নি এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতেন। শুরু থেকে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটাতে যা যা প্রয়োজন, সব ধরনের মিটিং করেছেন হত্যাকারীদের সঙ্গে। মিন্নি নিজেও এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আগে ও পরে খুনিদের সঙ্গে মিন্নির কথোপকথনও হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দু-একটি মিডিয়ায় এ নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডটি কোনো মাদকের কারণে ঘটেনি। ঘটেছে ব্যক্তিগত জিঘাংসার কারণে। মাদক বা অন্য কোনো ইস্যুর কথা উঠলে মামলাটির ফোকাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে। এ মামলায় বাদী যাদের হত্যাকারী দাবি করেছেন, আমরা তাদের প্রায় সবাইকেই ধরেছি এবং কাউকেই ছাড় দিচ্ছি না। এ পর্যন্ত আমরা এজাহারনামীয় আটজনকে গ্রেপ্তার করেছি। সর্বমোট ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অতএব, এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।’
পুলিশ সুপারের এই বক্তব্যের পরের দিন ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে মিন্নিকে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজীর কাছে মিন্নি রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়। জবানবন্দি শেষে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
Leave a Reply