শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥ বরিশালের নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ শপথ ও দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তার নাম ব্যবহার করে নগর ভবনে শুরু হয়েছে প্রভাব বিস্তারের লড়াই। তার অনুসারি হিসেবে দাবিদার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইতিমধ্যে কয়েকটি রুম দখল করে নিয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিন থাকা অপরাপর কর্মকর্তাদের কোনরূপ নোটিস ছাড়াই রুমগুলো ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আরও কয়েকটি রুম দখল চেষ্টার খবর পাওয়া গেছে। এই নৈরাজ্যকর অবস্থায় কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরী হয়েছে। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে প্রতিবাদ বা মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।
দখলবাজরা সকলেই আওয়ামী ঘরানার লোক। কিন্তু তারা নবনির্বাচিত মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারি নয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের বিতাড়িত করে অপেক্ষাকৃত নিম্ন পদের কর্মকর্তাদের এই রুম দখল প্রক্রিয়ার বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবহিত নয় বলে জানায়। তারা পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করে একে অপরের ওপর দায়ভার চাপিয়ে নিজেদের রক্ষার কৌশল নিয়েছে। অবশ্য তাদের বক্তব্যে অসহায়ত্বের বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই জবরদস্তিমূলক কর্মকান্ড মেয়র সাদিকের ইমেজ ও ইজ্জতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তারই শুভাকাঙ্খীরা মনে করছে। তবে এই বিষয়টি সম্পর্কে সাদিক আবদুল্লাহ এখনো অবগত নন বলে জানা গেছে।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে অনিয়মের অন্ত নেই বহু আগে থেকেই। সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের আমল থেকেই এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাপটীয় যুগ কায়েম করে। পরবর্তীতে বিএনপি দলীয় মেয়র আহসান হাবিব কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অভিযোগ রয়েছে, বরং অনিয়মের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। শওকত হোসেন হিরনের অনুসারিদের সাথে কামাল সমর্থিতরা অনেকটা ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সিটি কর্পোরেশন নিজেদের কব্জায় নেয়।
এ অবস্থায় অপর আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর অনুসারিরা দীর্ঘ দিন ধরে কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। বরিশাল রাজনীতিতে হাসানাতপুত্র সাদিক আবদুল্লাহ জোরালো অবস্থান নেওয়ার পর পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়র হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরই সাদিক আবদুল্লাহ সমর্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশ নড়েচড়ে ওঠে। নির্বাচনী পরিস্থিতিতে বিএনপি কোণঠাসা এবং সাদিকের বিজয় সময়সাপেক্ষ হয়ে দাড়ালে শুরু হয় নগর ভবনে তার নাম ব্যবহার করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা।
নির্বাচনী প্রচারনার শুরুতেই গত মাসে নগর ভবনের তিনটি রুম থেকে তিনজন কর্মকর্তাকে বিতাড়িত করে সেখানে আওয়ামী ঘরানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী তা দখল করে নেয়। এর মধ্যে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাও রয়েছে।
সরেজমিন নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় তলায় প্রকৌশলী শাখার কম্পিউটার রুমটি বস্তি উদ্বাস্তু কর্মকর্তা রাসেল খান দখল করে তিনি সেখানে অবস্থান নেন। সরিয়ে ফেলা হয় কম্পিউটার সরঞ্জামাদি। রাসেল দীর্ঘদিন ধরে সহকারী প্রকৌশলী বাশারের সাথে এক রুমে অফিস করতেন।
একই তলায় উপ-প্রকৌশলী সাইদুর রহমানের রুমটি দখল নেয় কম্পিউটারম্যান মিজান, রেজাউল ও ড্রাফটম্যান শাহিন। দ্বিতীয় তলায় পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধা দখল নেন নগর পরিকল্পনাবিদ নন্দিতা বসুর রুমটি। এই নারী কর্মকর্তা বর্তমানে পিএইচডি নিতে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। মে মাসে তিনি বাংলাদেশ ছাড়ার পর রুমটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল।
আগামী বছর তার দেশে ফেরার কথা। দীপক লাল এর আগে নগর ভবন সংশ্লিষ্ট বিবির পুকুর পাড়ের এ্যানেক্স ভবনের দ্বিতীয় তলায় অফিস করতেন। দীপক লাল আওয়ামী ঘরানার লোক হলেও রাজনীতিতে ততোটা সোচ্চার নন বলে জানা গেছে। সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্টজন ১৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আ’লীগ নেতা গাজী নঈমুল হোসেন লিটুর লোক হিসেবে পরিচিত দীপক।
অভিযোগ রয়েছে, সেই সুবাদে তিনি নগর ভবনে সাদিক আবদুল্লাহর নাম ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন বেশ কয়েক মাস ধরে। এ্যানেক্স ভবনে এই কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ রুমটি বেশ বিশালাকায় এবং নিরিবিলিও বটে। তা উপেক্ষা করে হঠাৎ করে নগর পরিকল্পনাবিদের রুম দখল নেওয়ার বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করে। তার থেকেও বেশি আলোচনায় আসে বস্তি উদ্বাস্তু কর্মকর্তা রাসেল খানের কম্পিউটার রুম দখল নেওয়ার বিষয়টি। প্রকৌশলীদের কাজকর্মের জন্য বরাদ্দ এই রুমটি অনেকটা জোর করেই তিনি দখলে নেয় বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য জানান। অনুরূপ উপ-প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) সাইদুর রহমানের রুমটি তিনজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী দখল করে নেয়। সাইদুর রহমান মাস্টার রোলে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা। তিনি বিএনপি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত।
রাসেল খান, মিজান, রেজাউল ও শাহিন এরা সকলেই আওয়ামী ঘরানার লোক। এর মধ্যে রাসেল খানের প্রভাবই বেশি। তিনি ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের সদ্য নির্বাচিত আ’লীগ মনোনিত কাউন্সিলর ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী মিনু রহমানের পুত্র। মিনু রহমান একসময় হিরন অনুসারি ছিলেন। বর্তমানে সাদিক আবদুল্লাহর রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করায় তার পুত্রের প্রভাব নগর ভবনে আপনাআপনি সৃষ্টি হয়ে যায়। জানা গেছে, সাদিক আবদুল্লাহ দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর এরা সকলেই তার অনুসারী হিসেবে নিজেদের জাহির করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে গোটা নগর ভবনে রাসেল খান ও দীপক লাল এই দুইজন সাদিক আবদুল্লাহ সমর্থিত গ্রুপের প্রধান হিসেবে আবির্ভাব হয়ে অনেকটা মোড়লপানা শুরু করে দেয়।
এইসব কর্মকর্তার রুম কিভাবে দখল করে বসলেন, তার কোন সদুত্তর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দিতে পারছেন না। নগর ভবনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওয়াহেদুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রুম বরাদ্দের বিষয়টি দেখভাল করেন প্রধান প্রকৌশলী খান মোঃ নুরুল ইসলাম। বর্তমানে ঢাকায় থাকায় এই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রুম বরাদ্দের তদারকির দায়িত্ব থাকলেও বর্তমানে বিষয়টি দেখছেন নির্বাহী প্রকৌশলী আনিচুজ্জামান। এই কর্মকর্তা জানান, রুম বরাদ্দের দায়িত্ব তার নয়। বরং অপরাপর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মন্তব্য অবান্তর।
অবশ্য আনিচুজ্জামান স্বীকার করে বলেন, রুম দখলের বিষয়টি দৃষ্টিকটু দেখালেও এর যৌক্তিকতাও আছে। তিনি রাসেল খানকে একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তার একক রুম পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দীপক লাল মৃধাও একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নগর ভবনের নতুন রুমে আসায় বাঁকা চোখে দেখার কিছুই নেই। কারণ এই কর্মকর্তার কাজকর্ম নগর ভবন ঘিরে হওয়ায় এ্যানেক্স ভবন একটু দূর হয়ে যায়। আনিচুজ্জামান দখলবাজদের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি সাবেক মেয়র হিরন ও বর্তমান মেয়র কামাল অনুসারিদের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে বলেন, এমন অনেকে এই নগর ভবনে রয়েছেন যারা মাস্টার রোলে কর্মরত থেকে মাসের পর মাস বেতন নেওয়ার পাশাপাশি দাপট দেখিয়ে আসছেন। তার এই মন্তব্যে অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, রুম দখলের ক্ষেত্রে তার সমর্থন রয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এমন তথ্য দিয়ে জানান, সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা এবং মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পথে নগর ভবনের অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তারা তার মতামত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আনিচুজ্জামান আওয়ামী ঘরানার লোক হিসেবে বহু আগে থেকেই পরিচিত। এক প্রশ্নের জবাবে আনিচুজ্জামান এই দখল প্রক্রিয়ার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপচারিতায় স্বীকার করে নেন, সাদিক আবদুল্লাহর নাম এই মুহূর্তে ব্যবহার করা আসলেই ইজ্জতের ব্যাপার বটে।
এ বিষয়ে নবনির্বাচিত মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় তার সেলফোনে কড়া নাড়লেও অপর প্রান্ত থেকে সাড়া মেলেনি।
Leave a Reply