রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন
এম.কে. রানা: ঘুর্নীঝড় ‘ফনী’র প্রভাব কেটে যাওয়ার পর থেকেই তীব্র তাপদাহে ওষ্ঠাগত বরিশালের মানুষ। তার ওপরে অসহনীয় লোডশেডিং। প্রতি ঘণ্টা অন্তর লোডশেডিং ও পানি সংকট নগরীরবাসীকে মাত্রাতিরিক্ত ভোগাচ্ছে। এতে করে রীতিমত হাপিয়ে উঠেছে রোজাদারেরা। আর বরিশালে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় গ্রাহক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট। ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৪ হাজার মেগাওয়াট।
সরকারি হিসাবে এখন প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। তবে উৎপাদনের এমন কৃতিত্ব সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে মøান হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
এদিকে বরিশাল আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মোঃ রুবেল জানান, গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বরিশাল অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৫ দশমিক ০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাত না হওয়ার আগ পর্যন্ত এই তাপমাত্রা নিচে নামার কোন সম্ভবনা নেই। বরং তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা প্রবল।
তিনি আরো বলেন, এধরণের তাপমাত্রা আরো দুই/তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এ ধরণের তাপমাত্রা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি লোডশেডিংও অব্যাহত থাকলে শিশু ও বৃদ্ধসহ দিন মজুরেরা দুর্ভোগে পড়বেন বেশি। জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়লেও সমস্যা রয়েছে বিতরণ ব্যবস্থায়। বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ লাইন সম্প্রসারণ ও সংস্কার যেভাবে হওয়া প্রয়োজন ছিল, বাস্তবে তাতে ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। দুর্ভোগ হচ্ছে গ্রাহকদের।
বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের বহু সাবস্টেশনের ওপর বাড়তি চাপ রয়েছে। নির্দিষ্ট এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও তা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে সারাদেশে বহু স্থানে জরাজীর্ণ খাম্বা উপড়ে পড়ছে। ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে গ্রাহকদের। সামনে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম।
এ সময়ে গ্রাহকদের দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সূত্রে জানা যায়, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় কোন ঘাটতি না থাকলেও বিতরন ব্যবস্থার ত্র“টির কারনে বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ নিয়ে চরম দূর্ভোগে সাধারণ মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত দু’বছরে ঢালাওভাবে নতুন সংযোগ প্রদানের পাশাপাশি বিদ্যমান গ্রাহকগন অধিক ক্ষমতার বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করায় চাহিদা প্রায় দ্বিগুন বেড়ে গেছে বলে বর্তমান সংকট ঘনিভুত হয়েছে। আর এ নগরীতে বেশীরভাগ গ্রাহকই কোন ধরনের অনুমোদন ব্যতিরকেই এয়ারকুলার সহ বিভিন্ন ধরনের অধিক ক্ষমতার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করলেও তা নিয়ে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রন নেই ওজোপাডিকো’র।
ফলে চলতি রমজান মাসের ইফতার থেকে তারবীর নামাজ হয়ে সেহেরী পর্যন্ত দফায় দফায় লোডসেডিং হচ্ছে খোদ বরিশাল মহানগরীতেও। কিন্তু বিদ্যুতের কোন ঘাটতি নেই। ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনারও প্রায় একই চিত্র। প্রায় এক যুগ আগে নির্বিঘœ বিদ্যুৎ সরবারহের কথা বলে বরিশাল ও খুলনা বিভাগ এবং ফরিদপুরের ৫টি সহ দক্ষিন ও দক্ষিন-পশ্চিমের ২১টি জেলা নিয়ে ‘পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরন কোম্পানী-ওজোপাডিকো’ গঠন করা হলেও এ দীর্ঘ সময়েও তারা সরবারহ ও বিতরন ব্যবস্থার কোন উন্নতি করতে পারেনি। এদিকে তীব্র তাপদাহে পুড়ছে ভোলা।
এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। জেলায় মৌসূমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রবাহিত হচ্ছে। দিনের তাপমাত্রা ছিলো ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা সারাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আপাতত বৃষ্টির কোন পূর্ভাবান নেই বলেও জানিয়েছেন তারা। এতে প্রচন্ড নাকাল অবস্থা মানুষের। গরম অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে মানুষ। রমজানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেনা মানুষ।
এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েছে গ্রাহকরা। গত সপ্তাহে জেলায় টানার বৃষ্টি হলেও গত ৩/৪ দিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। এতে গরমের কারেন দিনের বেশীর সময় মানুষের নাকাল অবস্থা। গরমের হাত রেহাই না পাচ্ছেন না দিন মজুরেরা। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ২/১ বার করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। এতে রোজা রেখে পুরোপুরি হাপিয়ে উঠেছেন বলে জানান তিনি।
১৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, রমজানের আগে লোডশেডিং কম থাকলেও এখন বেড়ে গেছে। পাশাপাশি পানি সংকট রয়েছে। এমন পরিস্থিতি কাঠফাটা রোদ ও ভাপসা গরম জনসাধরণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বরিশালসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও একইভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লোডশেডিং দেখা দিয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তবে বরিশাল ওয়েস্টান পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে এ অঞ্চলে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী (ওজোপাডিকো) বরিশাল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সরকার বলেন, বরিশাল গ্রিড সাবস্টেশনের আওতায় বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই।
বরিশালে মাত্র ১৫০ মেঘাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, চাহিদার চেয়ে ৫ গুন বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে বরিশালে। তিনি বলেন, দিন দিন গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বরিশালে নতুন কয়েকটি সাব স্টেশন শীঘ্রই হচ্ছে। তাছাড়া বেশ কিছু ফিডারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে ইতোমধ্যে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তর করার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়ন করাই আমাদের লক্ষ্য। আর তা করতে হলে উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়। তাই বিভিন্ন সময় কোন এলাকায় ত্রুটি দেখা দিলে সংযোগ লাইন বন্ধ করে কাজ করতে হয়। তখন গ্রাহকেরা ভাবেন, লোডশেডিং চলছে। অন্য দুটি গ্রিড সাবস্টেশন এবং এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও একই কথা বলছেন। অমূল্য সরকার বলেন, বরিশালে বর্তমানে কোন পূরণো ট্রান্সফরমার নেই।
তবে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জাহিদ হোসেন বলেন- ‘বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, তাদের ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমান তালে লোডশেডিং চলছে। ফলে বর্তমান সরকারের রেকর্ড পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্বেও গ্রাহক ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে।
Leave a Reply