রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
এম. কে. রানা:বরিশালে দিন দিন অব্যাহতভাবে শিশুশ্রম বেড়েই চলছে। বরিশালের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায়ই এখনও বেআইনিভাবে শিশুদের নিয়োগ দেয়া হয়। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। দারিদ্র, অশিক্ষা আর পেটের দায়ে কখনো অটোরিক্সার চালকের আসনে, কখনো ভাঙারী দোকানে, কখনো বাসের হেলপার আবার কখনো কখনো হোটেল-রেস্তোরায় কাজ করতে দেখা যায় দশ-বারো কিংবা চৌদ্দ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের। শুধু তাই নয়, অহরহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন- বিভিন্ন ওয়ার্কশপে, নির্মাণ কাজ, হোটেল-রেস্তোরা, ভাঙারী দোকান, বিড়ি কারখানা, জুতার কারখানা এবং বাস-ট্রাকে আশঙ্কাজনক হারে দিনদিন বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। তবে সঠিকভাবে কেউ-ই বলতে পারছেন না বরিশালে ঝুঁকিপূর্ণ বা শিশু শ্রমিক কতজন আছে। অবশ্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বরিশাল অফিস সূত্রে জানা যায়, এ যাবত প্রায় ৮শ’র মতো শিশু শ্রমিক তারা শনাক্ত করেছেন। যাদের মধ্যে ৫শ’ ৪ জন শিশু শ্রমিককে উদ্ধুদ্ধকরণের মাধ্যমে নিরসন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবী করেন তারা। অপরদিকে সচেতনমহল বলছেন, মানবিক কারণেই নারী ও শিশু শ্রমিকদের প্রতি নজর দিতে হবে। না হয় সরকারের মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন এবং মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি অধরাই থেকে যাবে। বিভিন্ন সংগঠন শিশুদের নিয়ে কাজ করলেও শিশু শ্রম নিরসনে কোন উদ্যোগ নিয়েছে কিনা জানা যায়নি। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্টদের। অবশ্য শিশু শ্রম নিরসনের লক্ষ্যে কলকারাখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বরিশালের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা মাঠ পর্যায়ে জড়িপের মাধ্যমে ৫শ’ ৪জন শিশু শ্রমিককে উদ্ধুব্ধকরণের মাধ্যমে নিরসন করতে সক্ষম হয়েছেন।
সরকারিভাবে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও শিশুদের কাজে নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন রুটের গণপরিবহন ও মালবাহী ট্রাকে হেলপার হিসেবে কাজ করছে অসংখ্য শিশু। বিভিন্ন পরিবহন, নির্মাণ কাজ, ওয়ার্কশপ কিংবা হোটেল রেস্তোরায় কম পারিশ্রমিকে সহজে পাওয়া যায় বলে মালিক কিংবা শ্রমিক সর্দারদের প্রথম পছন্দ শিশু শ্রমিক। সা¤প্রতিক সময়ে বরিশাল নগরীতে ব্যাটারী চালিত রিক্সা, অটোরিক্সার পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদেরকে অটোরিক্সা এবং রিক্সা চালাতে দেখা যায়। তাছাড়া নগরীর অলিগলিতে অটোরিক্সা মেরামত এবং তৈরী করার জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য গ্যারেজ। যে সব গ্যারেজে গেলে সহজেই চোখে পড়বে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ কতটা বেড়েছে। জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ১৪ বছরের মধ্যে সকলেই এ দেশের শিশু। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। এতে বলা হযেছে, শিশুর বেঁচে থাকা তাদের জন্মগত অধিকার। আর শিশুদের অধিকারের মধ্যে রয়েছে, স্নেহ, ভালবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার, অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার, একটি নাম ও নাগরিকত্ব, পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যত্ন ও সেবা শুশ্রুষা পাওয়া অধিকার, দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ ব্যবস্থা পাওয়ার অধিকার, সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার, শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার এবং এ সব অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বের সব শিশুর ভোগের অধিকার থাকবে। বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার রক্ষা ও তাদের বিকাশের জন্য রয়েছে নানা আইন। কিন্তু তার পরেও বাংলাদেশে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার। সমাজ থেকে শিশু-কিশোরদের যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার কথা তা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুনীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের ভারী গৃহশ্রমসহ বেআইনি কাজে যুক্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশুশ্রম জরিপে বলা হয়েছে, দেশে কোনো না কোনোভাবে শ্রমের সাথে যুক্ত রয়েছে এমন শিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। এ ছাড়া শিশুরা আরো কিছু বিচিত্র কাজেও নিয়োজিত। এর মধ্যে রয়েছে হকারি, ডাস্টবিনে ময়লা কুড়ানো, কুলি, রিকশা শ্রমিক, যৌনব্যবসা, ফুল বিক্রেতা, মাদক বাহক ও বিক্রেতা প্রভৃতি। আর এসব শিশু শ্রমিকের প্রায় ৫০ ভাগই তাদের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস।
এদিকে ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর প্রণীত বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে, যে কোন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গত ২০১১ সালে এসব শিশুদের সংখ্যা নিয়ে জরিপ করা এবং তাদের অবস্থা পরিবর্তনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোন ফল পাওয়া যায়নি। আর যাদের নিয়ে এত উদ্যোগ, তারাও এসব বিষয়ে কিছু জানে না। শ্রম আইনের ৩৯ এর (১) এবং (২) ধারায় বলা আছে- সরকার সময় সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে এবং সরকার কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোন কিশোরকে নিয়োগ করা যাবে না।’ তবে বিভিন্ন সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে মোটর ওয়ার্কশপ, ওয়েল্ডিং, ব্যাটারি ফ্যাক্টরি, গ্যাসের কারখানা, রিকশা চালানো, মাদক বাহক, রাস্তাঘাটে পান, বিড়ি-সিগারেট তৈরী ও বিক্রয়, বাস-ট্রাকের হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক, ইট ভাঙা, গৃহ শিশুশ্রম, ইত্যাদি খাতকে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে এসব পেশায় নিয়োজিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই বলে জানান শিশু শ্রমিকরা।
নগরীর কাউনিয়া এলাকায় কারিকর বিড়ি কারখানায় সরেজমিনে গিয়ে কথা হয়, শিশু শ্রমিক সোনিয়ার সাথে। সে জানায়, কাউনিয়ার একটি স্কুলে ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ে সে তবে স্কুলের নাম বলতে রাজী হয়নি সে। স্কুল শেষে কারখানায় কাজ করে। এক হাজার বিড়ি তৈরী করতে ১২ টাকা মজুরি পায় সে। সে জানায়, তার বাবা রিক্সাচালক। অভাবের সংসার তাই পড়ালেখার পাশাপাশি বিড়ি কারখানায় কাজ করে। একই কারখানায় কাজ করার নারী শ্রমিক লুৎফা তার শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন কাজ করতে। লুৎফার স্বামী অমৃত ফুড প্রোডাক্টস-এ দৈনিক ২শ’ টাকা মজুরী ভিত্তিতে কাজ করে। তাতে সংসার চলেনা এবং সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেন না। তাই প্রায় ১৫ বছর যাবত তিনি এ কারখানায় কাজ করছেন। একই কারখানার কাজ করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আঃ খালেক। তিনি জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর যাবত বিড়ি কারখানায় কাজ করেন তিনি। এতে তার শ^াস কষ্টের রোগ হয়েছে। অভাবে পড়েই তিনি এ পেশায় এসেছেন বলে জানান। এছাড়া সরেজমিন পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বেশ কিছু শিশু শ্রমিক পালিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার চাকরি বা কাজ হারানোর কথাও বলেছে।
হৃদয় নামে ১৪ বছর বয়সী এক রিক্সা চালকের সাথে কথা হয়। সে জানায়, তার বাবা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যাওয়ায় দুই ভাই বোন আর মাকে নিয়ে সংসার চালাতেই রিক্সার সিটে উঠেছে সে। নগরীর ভাটারখাল এলাকার মটর মেকানিকের দোকানের কর্মচারী রহিম নামে এক শিশু শ্রমিক জানান, তারা ৫ ভাই দুই বোন। বাবা রিক্সাচালক। তাই এখানে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে সংসারে সাহায্য করে সে। শুধুমাত্র সোনিয়া বা রহিমই নয় নগরীতে প্রায় সহস্রাধিক শিশু শ্রমিক নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, হোটেল ও গ্যারেজে কাজ করছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপে দেখা গেছে, দেশে শ্রমের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৭ লাখ শিশু। যাদের ১২ লাখই ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার ৩৮টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। শ্রম আইন অনুযায়ী এসব খাতে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের নির্দেশনাও রয়েছে। শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সামাজিক সংগঠন সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন করলেও আজও শিশুশ্রম বন্ধ হয়নি। শিশুদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী ও কর্তাব্যক্তিরা। এরা অল্প পারিশ্রমিক দিয়েই একজন শিশুশ্রমিককে দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করাতে পারেন। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে বেশির ভাগ শিশুই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অনিয়ন্ত্রিত পতিতাবৃত্তির কারণে পথ শিশু, টোকাই এর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এ ব্যাপারে বরিশাল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রবীন সাংবাদিক এ্যাড. এস.এম ইকবাল বলেন, শিশুদের শ্রমে নিয়োগ বে-আইনী এবং নিন্দনীয় কাজ। শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে সরকারি আইনের প্রয়োগ না থাকায় বরিশালে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বরিশালে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল হিমন কুমার সাহা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বা শিশু শ্রম বন্ধে তারা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও মালিক পক্ষের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তাদেরকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা এ পর্যন্ত বরিশাল নগরীতে প্রায় ৮শ’র মতো শিশু শ্রমিক শনাক্ত করেছেন। যাদের মধ্য থেকে উদ্ধুদ্ধকরণের মাধ্যমে বিড়ি কারখানার ৪শ’ ১০ জন, লেদ ওয়ার্কশপের ১২ জন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ৩৭জন এবং বিভিন্ন বেকারীর ৪৫জন শিশু শ্রমিক নিরসন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিশু শ্রম নিরুৎসাহিত করতে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক উদ্ধুদ্ধকরণ সভা করা হয়। তিনি আরো বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশণের মাধ্যমে বরিশাল অফিস থেকে এ পর্যন্ত ৬২টি শ্রমিক পরিবারকে ১২ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছে। শিশু শ্রম বন্ধে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক এবং সরকারেরও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে যা আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলেন তিনি।
Leave a Reply