শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২০ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥ এইচ এম হেলাল :
রাজনৈতিক নেতা হয়ে স্বল্প দিনের ব্যবধানে বরিশালের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মানসিক ও চারিত্রিক ভূমিকায় আমূল পরিবর্তন আসছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তার নিকটস্থদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এ তথ্যের সার কথা হচ্ছে- তরুণ এই নেতা মেয়র হিসেবে নগর উন্নয়ন ও রাজনীতিতে একটি মডেল তৈরী করতে আগ্রহী। তা বাস্তবায়নে তিনি কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। শুরু করতে পারেন দলের মধ্যেকার দুর্বৃত্ত ও স্বার্থান্বেষী নেতা-কর্মীদের মানসিক শুদ্ধিকরণ অভিযান। প্রথম ধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বরিশাল আধুনিকায়ন করতে যা করণীয় তার প্রতিফলন ঘটাতে চান। এটা শুধু তার নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নয়, বিতর্ক এড়িয়ে রাজনীতিতে স্বচ্ছভাবে টিকে থাকার একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ বিশেষ।
যতটুকু আভাস পাওয়া গেছে তাতে অনুমান করা যাচ্ছে, একটি মাস্টার প্লান মাফিক বরিশাল রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে একটি শক্ত-পোক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে, বিএনপি প্রভাবিত বরিশাল রাজনীতিতে শত উন্নয়ন করেও আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক বাড়ানো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। যার উদাহরণ হিসেবে প্রয়াত সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রতিদান হিসেবে নির্বাচনে তার করুণ পরাজয়কে তিনি আমলে এনেছেন। সেই সাথে নিন্দুকদেরও জবাব দিতে চান বয়সে তরুণ হলেও তার রাজনৈতিক দক্ষতা বা কারিশমা যাই কিছু বলা হোক না কেন সবই তার নিজস্ব ‘আইডলোজি’। প্রতিপক্ষরা সমালোচনার টেবিলে সাদিক আবদুল্লাহর স্বল্প দিনে রাজনৈতিক উত্থান এবং কাক্সিক্ষত লক্ষ্য মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পেছনে তার পিতা প্রবীণ ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর অবদানের প্রতিফলন বলে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এ কথা একেবারেই যে মিথ্যা তা তিনি অস্বীকার করেন না।
বিভিন্ন আঙ্গিকে যে মন্তব্য পাওয়া যায়, সাদিক আবদুল্লাহ তার এতদূর আসার পেছনে অবশ্যই পিতার অবস্থানগত কারণকে অনেকাংশে সহায়ক হিসেবে মনে করেন। কিন্তু নিজের দক্ষতা না থাকলে অর্থাৎ গাড়িতে তেল না থাকলে ঠেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে যে যাওয়া যায় না সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চান তরুণ এই নেতা। তার এই উক্তি হাস্যকর বলে এখন নিন্দুকদের উড়িয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে অনেকেই মনে করছে। গত চার বছর বরিশাল রাজনীতির দিকে ফিরে তাকালে অনেক প্রশ্নের সহসাই উত্তর মেলে। দেখা গেছে, সাদিক আবদুল্লাহ যুব নেতা হিসেবে বরিশাল রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেই প্রথম টার্গেট নেন মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাই পেতে একটি পদ-পদবী পাওয়ার জোর প্রত্যাশা। তৎকালীন সময় প্রয়াত নেতা শওকত হোসেন হিরনের রেখে যাওয়া জনপ্রিয়তার বিশাল মঞ্চ থেকে রাজনীতির মাঠে ছড়ি ঘুরানো সাংসদ জেবুন্নেছা আফরোজকে প্রকাশ্যে সহায়তাকারী প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী আমির হোসেন আমু’র সাথে নেতৃত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয় এই তরুণ রাজনীতিককে।
একটি বিষয় পরিস্কার ছিল যে, এক্ষেত্রে তার পিতা কোনভাবেই তাকে সহায়তা করেননি। এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনে কথা উঠেছিল, পিতা চান না পুত্র সাদিক বরিশাল রাজনীতিতে ঘুরপাক খাক। আবার এমন অসহায় দৃশ্য দেখা গেছে যে, পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ পুত্রকে সহায়তা করবে কি? নিজেকে নিজেই আড়াল করে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন আমু-জেবুন্নেছার রাজনৈতিক কুটকৌশলের কাছে। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রবীণ নেতা হওয়া সত্ত্বেও সাংসদ জেবুন্নেছার উদ্যোগে বরিশালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বা অনুষ্ঠানে আমির হোসেন আমুকে প্রধান অতিথি করে রাজনীতির বিভাজনে হাসানাত পরিবারকে উপেক্ষা করা হয়। এসময় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহতে সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে নীরব থাকতে দেখা যায়। কিন্তু পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ কৌশল মাফিক পথ হাটতে থাকেন। সাফল্যও পেয়ে যান অল্প দিনে। জেবুন্নেছার ভিত নড়বড় হয়ে যায় সাদিকের সাংগঠনিক কারিশমায়। নগরীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে এবং ওয়ার্ড নেতারা সাদিকের অনুকূলে ভিড়ে তাকে নিয়ে আসে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
রাজনীতির কি খেলা?
একসময় একাকী হয়ে পড়া সেই জেবুন্নেছা আফরোজই প্রতিপক্ষ নয়, ভাই সম্বোধন করে তিনিই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সাদিক আবদুল্লাহকে বরিশালে দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অন্য আরেক চিত্রে দেখা গেছে সেই প্রভাবশালী মন্ত্রী আমির হোসেন আমু পুত্র সমতুল্য সাদিক আবদুল্লাহর কপালে স্নেহের হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করেন, সম্ভবত বলেছেন এগিয়ে যাও বৎস। ঠিকই এগিয়ে গেলেন সাদিক। পেয়ে গেলেন দলীয় মেয়র মনোনয়ন। একটি কথা জোর শোনা যায়, সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তার পিতার কৌশলের কাছে অপরাপর সম্ভাব্য প্রার্থীরা পেরে ওঠেনি। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিকটাত্মীয় বিধায় সাদিকের মনোনয়ন লাভ সহজতর হয়ে যায়। কিন্তু মনোনয়ন নিশ্চিতের বিষয়টি অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী মনে গেঁথে রেখেছেন। কেউ কেউ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সম্প্রতি বরিশালে অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন জনসভায় সাদিকের জনপ্রিয়তার মাপকাঠী নেত্রী অনুমান করে তার প্রতিদান দিলেন মনোনয়ন দিয়ে। দলীয় প্রার্থীতা নিশ্চিত হওয়ার পর নিন্দুকদের নতুন সুর ছিল, নির্বাচন হবে একচেটিয়া এবং এই যুবক মেয়র হলে বরিশাল পরিণতি ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনকালীন প্রচারণায় এই বিষয়টি জোরালোভাবে ছড়ানোর চেষ্টা পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনার টেবিল থেকে শোনা যায়। সর্বশেষ ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না।
আবার এ কথাও সত্য যে এবার মেয়র নির্বাচনে বরিশালের মত জায়গায় বিএনপির গা-ছাড়া ভাব আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচনী মাঠ দখল সহজতর হয়ে ওঠে। খোদ বিএনপির ভেতর থেকেই কথা উঠেছে, দলীয় মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার নির্বাচনে অংশ নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। তার টার্গেট আগামী সাংসদ প্রার্থী হওয়া। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সব বিতর্ক ঢাকা পড়ে যায় সাদিক আবদুল্লাহর বেশ কিছু প্রশংসনীয় ভূমিকায়। নির্বাচনী প্রচারণায় সেই শওকত হোসেন হিরনের ভঙ্গিমা অনুসরণ করা আর রাজপথে পাগলের সাথে আলাপচারিতায় সাদিক আবদুল্লাহর স্পর্শকাতর কিছু চিত্র সাধারণ ভোটারদের আলোড়িত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে শত বিতর্ক ঢাকা পড়ে গিয়ে যুবক সাদিক আবদুল্লাহই হলেন মেয়র। শুধু নির্বাচিতই হলেন না রেকর্ডও গড়লেন।
যদ্দুর শোনা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে মেয়র হিসেবে তিনিই সর্বকণিষ্ঠ এবং তাও আবার স্বল্প দিনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। সেই সাথে রেকর্ড পরিমাণ ভোট প্রাপ্তি। সঙ্গত কারণে সাদিক আবদুল্লাহ পুলকিত-আন্দোলিত।
তার দল ঘনিষ্ঠরা জানান, সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকটা একাকী চলতে শুরু করেছেন। তার বাস ভবনে নেতা-কর্মীদের যাতায়াত এবং আড্ডার সময়সীমাও হ্রাস টেনেছেন। এখন সাদিক আবদুল্লাহ নিজেই বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বাসায় আকস্মিত উপস্থিত হয়ে কুশল বিনিময় করে আসছেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদদের আশ্বস্ত করছেন এখন তিনি রাজনীতিতে অনেক পরিণত হয়েছেন। তার চারপাশে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদদের স্থান থাকবে। বিশেষ করে দলের জন্য ত্যাগীরা পাবে প্রাধান্য। আগামিতে পথ চলতে চান হিসেব কষেই। ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন স্বার্থবাদীদের দল থেকে উৎখাত করার।
শোনা যাচ্ছে- দলের মধ্যে তার নাম ব্যবহার করে পথচলা নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে তিনি বেশ সতর্ক। পাশাপাশি নগর উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তারও একটি তালিকা একাকী তৈরী করছেন। আর সুযোগ পেলেই পরিবার পরিজনের সাথে সময় দিয়ে নিজেকে ফুরফুরে মেজাজে রাখতে চাইছেন। একাধিক সূত্র ধারণা দিয়েছে, তিনি কোন অন্যায় বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে কাউকে দেবেন না। নিজেও নেবেন না। একটাই লক্ষ্য- শুধু এই চার বছরের জন্য নয়, এমন কিছু করতে চান যাতে আগামীতে তার প্রার্থীতার জন্য দলের মধ্যে কোন লড়াই করার সুযোগ না থাকে।
তবে সতর্ক বার্তা হচ্ছে- ছাত্র-যুবলীগ নেতৃবৃন্দ টেন্ডারবাজীর জন্য মেয়র সাদিকের আমল স্বর্ণযুগ বলে মনে করে ঢেকুর গিলছে। আসলে তা হজম করা সম্ভব নাও হতে পারে নয়া মেয়রের এই অনড় মনোভাবের কারণে। অনেকের সন্দেহ সমবয়সী মহানগরের বেশ কয়েকজন নেতা যাদের পরিচয় ভোল পাল্টানো তারাই সাদিক আবদুল্লাহকে অক্টোপাসের মত ঘিরে রেখেছে। শুধু স্বার্থ নয়, তাদের লক্ষ্য অস্তিত্বও রক্ষা। এদের কবলমুক্ত হতে না পারলে সাদিকের লালিত স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সে প্রশ্ন উঠেছে। যদি বর্তমান মনোভাবের সাথে বাস্তবতার মিল দেখাতে পারেন তাহলে তরুণ এই নেতা হয়ে উঠতে পারেন এক ‘রাজনৈতিক আইডল’।
আপাতত যা দেখা যাচ্ছে- তাতে মনে হচ্ছে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা সেই সাদিক আবদুল্লাহ আর বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ হয়তোবা এক হবে না। গতকাল শনিবার দুপুরে বিমানে ঢাকা থেকে ফিরে সাদিক আবদুল্লাহ যেভাবে নীরবে ঘরে ফিরলেন তাতেই ইঙ্গিত বহন করে তিনি শুধু দলের নয়, এখন সবার মেয়র, সবার নেতা। পূর্বেকার সংবর্ধনা বা মহড়া দিয়ে ঘরে ফেরার রেওয়াজ ভাঙলেন বৈ কি?
Leave a Reply