রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৪ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি॥ চলতি বছরের ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে দলে ব্যাপক রদবদলের চিন্তা ভাবনা করছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে চলমান অভিযানে দলের অনেক হেভিওয়েটরাই বিতর্কের তালিকায় চলে এসেছেন। ফলে আসন্ন সম্মেলনে দলকে আরও জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করতে দুর্নীতিবাজ ও অপকর্মে জড়িতদের বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজ ও তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের দিকে নজর দলীয় প্রধানের।
বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠক করেছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে দলের ত্যাগী নেতাদের তৃণমূল থেকে তুলে নিয়ে আসার ব্যাপারে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
দুর্নীতির কিংবা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এমন প্রভাবশালী নেতাও এবার কাউন্সিল থেকে পদ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
অন্যদিকে শীর্ষ নেতৃত্বে ক্লিন ইমেজের নেতারা চলে আসবেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলে পুরো দলকে ঢেলে সাজাতে ‘ক্লিন ইমেজকে’ প্রধান মানদণ্ড করছে দলটির হাইকমান্ড।
বৈঠকে উপস্থিত নেতারা জানিয়েছেন, দলে শুদ্ধি অভিযানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অবস্থান অনড়। দলের নেতাদের হুঁশিয়ার করে তিনি বলেছেন, দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য এই অভিযান চালাতে হবে। এই অভিযানে অভিযুক্তদের কেউ যেন শেল্টার (আশ্রয়) দেয়ার চেষ্টা না করে।
শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে সব ধরনের সম্মেলনের মাধ্যমে হওয়া নতুন কমিটিগুলোতে যাতে অনুপ্রবেশকারী প্রবেশ করতে না পারে সেই দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের অনুপ্রবেশকারী ও অপকর্মকারীদের তালিকা করা হয়েছে। এরা যাতে নতুন কমিটিতে স্থান না পেতে পারে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে গণভবনের গেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।
চলমান অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারও নাম উল্লেখ করে আলোচনা হয় নাই। তবে, চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
আওয়ামী লীগের বিষয়ে দলটির সভাপতির নির্দেশনা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতারা আওয়ামী লীগের আগামী কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাবে। আওয়ামী লীগের সম চিন্তার নয় এমন কেউ যাতে দলের ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে না পরে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে দলে অনুপ্রবেশকারী ও অপকর্ম যারা করেছে তাদের একটা তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিভাগীয় দায়িত্বে যারা আছেন তাদের এই তালিকাটি দেখবার জন্য বলেছেন, তালিকা দেখে যার যার এলাকায় কমিটি গঠনে সতর্ক এবং সজাগ থাকার জন্য বলেছেন, যাতে এই ধরনের লোকেরা আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান না পেতে পারে সেই ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।’
এ সময় আওয়ামী লীগের চারটি সহযোগী সংগঠন- যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষকলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ, ২০১২ সালে সম্মেলন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘৭ বছর অতিক্রান্ত, কাজেই এসব সংগঠনের সম্মেলন জাতীয় সম্মেলনের আগে নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার জন্য আমাদের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। রাতে আমাদের অফিসের মাধ্যমে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সংগঠনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে দলের মধ্যে থেকে যারা অপকর্ম করেছে তাদের আউট করা হবে। জনগণের অভিযোগ আছে, এমন লোককে দলের নেতৃত্বস্থানীয় কোনো পদে বসানো হবে না।
দলটির নেতারা মনে করছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে নীতি নিয়ে সরকার অভিযান চালাচ্ছে, সেটি সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। কারণ এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এর মাধ্যমে দলের ভাবমুর্তি তো বটেই, সরকারের পক্ষেও জনসমর্থনও হু হু করে বাড়বে।
এছাড়া জানা গেছে, দলীয় বেশ কিছু কেন্দ্রীয় পদে আসতে যাচ্ছে বেশ কিছু নতুন মুখ। দলে এবার বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নবীন নেতৃত্ব আনতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেই হিসাবে এবার দলীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক রদবদল হতে যাচ্ছে। সাবেক ছাত্রনেতা ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতাদের সেই স্থানে আনা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ৭০ বছর পার হওয়া আওয়ামী লীগ দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্ব আনার চিন্তা-ভাবনা এখন থেকেই শুরু করেছে। দলের আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের ইউনিটের কমিটি গঠন করে সম্মেলন করতে চায় আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। আর এসব ইউনিট পর্যায়ের নেতৃত্ব তুলে দিতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের খোঁজে রয়েছেন তারা। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে দলটি। একইসঙ্গে কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব আনতে চলেছে আওয়ামী লীগ।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে পারে বেশ কিছু নতুন মুখ। দলের গত তিনটি জাতীয় সম্মেলনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নতুনদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছে ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই হিসাব মতো, দলের আগামী ২১তম সম্মেলনে নতুন বেশ কিছু নেতৃত্ব আনার সম্ভাবনা রয়েছে দলটির। দলের তৃণমূল থেকে ত্যাগী নেতাদের কেন্দ্রের দায়িত্বে এনে পুরস্কৃত করা হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরে সম্মেলনে দলের যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদের প্রায় সবগুলোয় আসতে পারে নতুন মুখ। পরিবর্তন আসতে পারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও। যারা দলের যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে যারা টানা তিন সম্মেলনে একই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অন্তত দুজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন। আর ৮ সাংগঠনিক সম্পাদক পদের বেশিরভাগেই নতুন মুখ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির অন্তত দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবার দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হতে পারেন। এ ছাড়া বাকি দুইজন একই পদে বহাল কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হতে পারেন। শূন্য থাকা দলের কয়েকটি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে এবার জেলা পর্যায়ের সিনিয়র, ত্যাগী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আনা হতে পারে। জানা গেছে, বর্তমান কমিটির বেশ কয়েকজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিয়ে দলে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে, যারা দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অনুপস্থিত। এদের অনেকেরই বয়স হয়েছে। তেমন কয়েকজন এবার সভাপতিমণ্ডলীর পদ হারাতে যাচ্ছেন। তাদের জায়গা হবে দলের উপদেষ্টা পরিষদে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে ছিলো এবং টানা তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনায় কম-বেশি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানেও থেকেছে দলটি। তবে টানা তিন দফায় ক্ষমতায় থাকার কারণে কিছু দুর্নীতিবাজ এর সুযোগ নিয়েছে, যার মধ্যে দলের ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীলদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশও জড়িয়ে পড়েছে। এসব দুর্নীতি তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে যেমন বিব্রত করছে, তেমনি উন্নয়ন অর্জনকেও ম্লান করছে। সেজন্য এবারের যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। এর ব্যাপকতা থাকবে দীর্ঘমেয়াদে।
তারা জানান, আগামী কাউন্সিলে সবচেয়ে বড় চমকের দেখা মিলবে। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে অনেক প্রভাবশালী নেতার নামের পাশেই লাল দাগ পড়ে গেছে। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের রিপোর্ট এরই মধ্যে দলের হাইকমান্ডের নজরে এসেছে। অর্থাৎ কাউন্সিলে অনেক হেভিওয়েট নেতারা পদ হারালে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। আবার অনেক প্রতিশ্রুতিশীল নেতা উঠে আসবেন যাদের নামের পাশে ‘ক্লিন ইমেজ’ তকমা আছে।
তৃণমূল কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন নেতারা জানিয়েছেন, দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানে শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই নন, এর আওতায় আসছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও। আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলনের যে নির্দেশ রয়েছে, তাতে ক্লিন ইমেজের নেতাদের তুলে আনা হবে।
দলের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি আদর্শিক দল। আওয়ামী লীগ করতে গেলে সবাইকে আদর্শিক হতে হবে। আদর্শ ধারণ করে লালন এবং পালন করতে হবে। দলে যারা নতুন আসবে তাদের উচিত দেশকে ভালবেসে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করা।
Leave a Reply