মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন
শফিকুল ইসলাম খোকন॥ ‘দিন রাত শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই থাকতে হয়। প্রতিটি নিঃশ্বাসে শরীরে থাকা হাজারো স্প্লিন্টার যন্ত্রণা দিচ্ছে। এখনো সেই যন্ত্রণা নিয়েই আমার জীবন কাটছে। সেই ২১ আগস্টের রক্তাক্ত স্মৃতি প্রতিক্ষণ আমাকে যন্ত্রণা দেয়, মনে করিয়ে দেয়।’
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াল স্মৃতির কথা মনে করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি নাসিমা ফেরদৌসী।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা দীর্ঘ বছর বলতে বলতে আর যেন বলতে পারছেন না। শরীরের হাজারো স্প্লিন্টারের অসহ্য যন্ত্রণা প্রতিনিয়তই কাঁদায় তাকে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। আইভী রমানের পাশেই ছিলেন নাসিমা ফেরদৌসী। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। এতে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ অনেক প্রাণ ঝরে যায়। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতা আহত হন। গুরুতর আহতের মধ্যে ছিলেন নাসিমা ফেরদৌসীও।
নাসিমা ফেরদৌসী সেই স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল যেন, চারদিকে আগুনের ফুলকি ঘেরাও করেছে। এরইমধ্যে আমি টের পেয়ে যাই, আমার শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। শরীর থেকে ঝরছে রক্ত। চারদিকে তাকিয়ে দেখি, সবারই একই অবস্থা। এরপর কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, তা খেয়াল নেই। অজ্ঞান অবস্থায় মৃত ভেবে তোলা হয়েছিল লাশের ট্রাকে। কিন্তু নড়েচড়ে ওঠার পরে পুলিশ আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফেলে রাখা হয়, হাসপাতালের করিডোরে। একজন মানুষ এসে আমার কাছে আত্মীয়-স্বজনের মোবাইল নম্বর চাইলেন। ছেলের মোবাইল নম্বর দেয়ার পর তার সঙ্গে যোগোযোগ করল। এরপর আর কিছুই মনে নেই আমার।
তিনি আরো বলেন, দুই পা বিকল হওয়ায় চার বছর শয্যাশায়ী ছিলাম। চার মাস সারা শরীরে স্পঞ্জ লাগানো ছিল। এরপর হুইল চেয়ার, স্ট্রেচার এবং ওয়াকারের মাধ্যমে হাঁটা শেখানো হয়। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট; হাঁটতে কষ্ট, শুতে কষ্ট, এত অশান্তির মাঝেও সান্ত্বনা খুঁজে পাই। সান্ত্বনা খুঁজে পাই এই ভেবে যে, মারা গেলে হয়তো পৃথিবীর আলো-বাতাস আর দেখতে পেতাম না। মাঝে মাঝে অবাক ও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কখনো কখনো ঘরে থাকা সেই ভয়াল স্মৃতির ছবি দেখে সময় কাটাই। নিজের ছবি দেখে নিজেকে সামলাতে পারি না।
নাসিমা ফেরদৌসী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় নারীদের পাশে থাকবো। তাদের অধিকার রক্ষা, দুস্থ নারীদের সহযোগিতা করার লক্ষে কাজ করছি। গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার হলে আত্মার শান্তি পাব।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার প্রান্তিক জনপদ বাদুরতলা গ্রামে নাসিমা ফেরদৌসীর জন্ম। সেখানেই কাটে শৈশব আর কৈশর। পারিবারিকভাবেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে তিনিও শুরু করেন রাজনীতি। একপর্যায়ে তৃণমূলের গণ্ডি পেরিয়ে রাজনীতি শুরু করেন রাজধানী ঢাকাতে। ১৯৭৯ সালে মহিলা আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে দলীয় কাজ শুরু করেন।
১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তিনি রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সেখান থেকে শুরু হয় তার রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে চলাচল। রাজপথে লড়াকু সৈনিক হিসেবে আন্দোলন করে মহিলা আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর (উত্তর) শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
Leave a Reply