মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২২ পূর্বাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন॥ সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাগরপারের জেলা শহর বরগুনা একটি রেকর্ড গড়েছিল। জেলার দুটি নির্বাচনী আসনের অন্যতম সদর আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন ৫২ জন নেতা। একটি আসনের এমপি হওয়ার জন্য ৫২ জনের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহের বিষয়টি তখন সারা দেশে বেশ আলোচনা হয়েছিল।
গণমাধ্যমেও বিষয়টি আলোচিত-সমালোচিত হয়। চলমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে সেই বিষয়টিই আবার আলোচনায় এসেছে। করোনাদুর্গতদের সহায়তা পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এমপি হওয়ার আশায় ৫২ নেতা দলীয় মনোনয়ন চাইলেও মানুষের চরম বিপদের সময়ে তাদের ৪৫ জনকেই খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। অসহায় মানুষকে সহায়তা দেয়া তো দূরের কথা ফোন করে একটু খোঁজখবর পর্যন্ত নিচ্ছেন না তারা।
প্রায় ২৮ বছর ধরে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। মাঝে একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেনের কাছে পরাজিত হওয়া ছাড়া জীবনে পাঁচবার এমপি হয়েছেন। মোটা দাগে দেখতে গেলে এখনও অনুন্নত জেলা বরগুনায় বহু বছর ধরে চলছে তার একাধিপত্য। বিগত জাতীয় নির্বাচনে শম্ভুর বিরোধিতায় নেমে এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন আরও ৫১ জন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য মনোনয়নের শিকে ছেড়ে শম্ভুর ভাগ্যেই। চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা আর মিন্নি-নয়ন বন্ডের ঘটনার সঙ্গে ছেলে সুনাম দেবনাথের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় খানিকটা হলেও বিপাকে পড়েছিলেন শম্ভু। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই তিনি বরগুনায় ছিলেন। করোনাদুর্গতদের সহায়তার ব্যাপারে জানতে চাইলে এমপি শম্ভু বলেন, সদর আসনের আওতাধীন তিন উপজেলাতেই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছি। এছাড়া আমার ছেলে সুনাম দেবনাথের পরিচালিত ব্লাড ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হয়েছে।
বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, সরকারি সহায়তা বিতরণকে যদি নিজের ত্রাণ বলা হয় তাহলে তো আর কারও কিছু বলার থাকে না। পরিবেশ আন্দোলনের বরগুনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান আরিফ বলেন, এমপি সাহেব বর্ষীয়ান মানুষ। তিনি সহায়তা দিচ্ছেন ঠিক আছে। তবে এটা আরও বড় পরিসরে হওয়া উচিত ছিল। কেননা তিনি কেবল একটি আসনের এমপি নন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
মনোনয়ন চাওয়া ৫২ জনের আরেকজন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জেলা চেম্বারের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির। শম্ভুর মতো তিনিও টানা ২৮ বছর ধরে আছেন জেলা সাধারণ সম্পাদক পদে। স্থানীয় একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, চেম্বার সভাপতি হিসেবে সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকদের সহযোগিতা দিয়েছেন জাহাঙ্গীর কবির। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কেবল চেম্বার নয়, ব্যক্তি উদ্যোগেও হাসপাতালের রোগীসহ আরও অনেককে সহায়তা দিয়েছি।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘দালালির ব্যবসাটা ভালোই বোঝেন আমাদের এখানকার কিছু আওয়ামী লীগ নেতা। রবিনহুডের মতো ধনীদের কাছ থেকে এনে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া আর নিজের পকেটের টাকা পকেটে রাখা তাদের একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তারা যা দিচ্ছেন মূলত এভাবেই দিচ্ছেন।
দুই নেতার বাইরে দলীয় মনোনয়ন চাওয়া বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন এবং পৌর মেয়র শাহাদাত হোসেন করোনাদুর্গতদের সরকারিভাবে আসা সহায়তার চাল, ডাল ও আলু দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে দেলোয়ার জেলা পরিষদের মাধ্যমে তিন হাজার এবং শাহাদাত পৌরসভার মাধ্যমে কয়েক হাজার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। বড়সড় দলীয় পদ ও পোর্টফোলিও থাকা নেতাদের বাইরে মনোনয়ন চাওয়া ৫২ জনের মধ্যে করোনা দুর্যোগের শুরু থেকে ত্রাণ নিয়ে মাঠে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মশিউর রহমান শিহাব।
এ পর্যন্ত ৩০ হাজার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার কথা উল্লেখ করে শিহাব বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে গঠন করা কুইক রেসপন্স টিমের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে সহায়তা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রথম ধাপে ৩০ হাজার মানুষকে দেয়ার পর এখন এ টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। আসন্ন ঈদ উপলক্ষেও নতুন করে বিশেষ সহায়তা দেয়ার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
শিহাবের এ ত্রাণ বিতরণকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ তৈরি এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, তিনি (শিহাব) যদি নির্মল মন নিয়ে সহায়তা দিতেন তাহলে কেবল সদর আসনের তিনটি উপজেলা নয়, পুরো জেলাতেই দিতেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিহাব বলেন, আমি তিন উপজেলায় দিচ্ছি। যারা এসব বলছেন তারা তাদের নির্মল মন নিয়ে বাকি উপজেলাগুলোয় দিক। এছাড়া আমি তো আর অঢেল অর্থ-সম্পত্তির মালিক নই। দুর্যোগের শুরুতে যখন এন-৯৫ মাস্কের সংকট তখন বরগুনার চিকিৎসকদের আমি সেই মাস্কও দিয়েছি।
মনোনয়ন চাওয়া উল্লেখিত নেতাদের বাইরে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু এবং যুবলীগ সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজও দরিদ্র মানুষকে সাধ্যমতো সহায়তা দিয়েছেন। এ দুই নেতা বরগুনার কয়েক হাজার মানুষকে সহযোগিতা করেছেন বলে জানা গেছে। তবে এই সাতজন ছাড়া মনোনয়ন চাওয়া বাকি ৪৫ জনের কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না বরগুনার করোনাদুর্গতরা। চরম এ বিপদের মুহূর্তে পাশে থাকা তো দূরের কথা সহযোগিতার আশায় করা ফোন পর্যন্ত ধরছেন না তাদের কেউ।
এদিকে বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক সংগঠন এগিয়ে এসেছে অসহায় দরিদ্রদের পাশে। হোপ বরগুনা নামে একটি সংগঠন প্রায় চার হাজার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া কোস্টাল ইয়ুথ নেটওয়ার্কসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন দরিদ্রদের সহায়তা দিচ্ছে।
বরগুনা জেলা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক হাসান ঝন্টু বলেন, নির্বাচন এলেই দেখি ভোটের মাঠে মৌসুমি পাখির ভিড়। গত নির্বাচনে তো এখানে মনোনয়ন প্রার্থীদের ভিড়ে পথে হাঁটাই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু চরম দুর্যোগের এ সময়ে অসহায় মানুষের পাশে তাদের না থাকা প্রমাণ করে তারা সবাই সুখের পাখি। উড়ে এসে জুড়ে বসার আশায় তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আজ চরম দুঃসময়ে তাদের আসল রূপটা চিনতে পারছে সবাই। হাতেগোনা ৬-৭ জন ছাড়া আর কেউই অসহায় মানুষের পাশে নেই। অথচ তারা সে সময় একটা রেকর্ড তৈরি করেছিলেন। তাদের প্রতি দুঃখবোধ ছাড়া আর কিছুই নেই বরগুনার সাধারণ মানুষের।সুত্র,যুগান্তর
Leave a Reply