শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন
সুশান্ত সাহা॥ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিনকে দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। অলি-গলিতে কিশোর গ্যাং’র তৎপরতা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে শান্তিপ্রিয় মানুষের মাঝে। এলাকায় স্কুল কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছোট ছোটে গ্রুপে ভাগ হয়ে চুরি, ছিনতাই, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এরা।
শুধু তাই নয়, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এক গ্রুপের সদস্যরা অন্য গ্রুপের সদস্যদের খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় দু’গ্রুপের বিরোধের জেরে স্কুলছাত্র আদনান নিহত হওয়ার পর ‘গ্যাং কালচার’ আলোচনায় আসে। গত বছরও এসব গ্যাংয়ের হাতে কয়েক কিশোর নিহত ও এলাকাভিত্তিক সংঘর্ষের সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিশোর গ্যাং’র বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি চক্র গ্রেপ্তার করে। কিন্তু করোনাকালে এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় কিছুটা শিথিলতা দেখা দেয়ায় আবারো তারা মাঠে নেমেছে সদলবলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- পারিবারিক শিক্ষা, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে কিশোররা এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বাড়ইভোগ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় পাঁচজন আহত হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় মাদক বিক্রি করে আসছে। রাতে মাদক বিক্রি করার সময় এলাকাবাসী বাঁধা দিলে প্রথমে দুই গ্রুপের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এসময় কিশোর গ্যাংয়ের মাদক ব্যবসায়ীরা দু’জনকে কুপিয়ে জখমসহ ৫ জনকে আহত করে। পরে আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে সদরের নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে বুলু ও হৃদয় নামে গুরুতর আহত দু’জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় সোহাগ নামের এক কিশোর ওই চক্রের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ জানায়, ওইদিন রাতে দক্ষিণখান রাজাবাড়ী খ্রিষ্টানপাড়া রোডের ডাক্তারবাড়ী মোড়ে কিশোর গ্যাং ‘দি বস’র হৃদয়, রাসেলসহ বেশ কয়েকজন সদস্য আড্ডা দিচ্ছিল। রাত সাড়ে ৮টার দিকে একই রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি রিকশার চাকা থেকে কাদা ছিটকে হৃদয়ের গায়ে লাগলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রিকশাচালককে মারধর করতে থাকে। একজন অসহায় রিকশাচালককে সমবয়সী একজন ছেলেকে মারতে দেখে সোহাগ এগিয়ে আসে। সোহাগের প্রতিবাদে হৃদয় ও রাসেল ক্ষিপ্ত হয়ে ফোন করে তাদের গ্যাং’র অন্য সদস্য নাদিম, সানি, মেহেদী, সাদ, সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনকে ডেকে আনে এবং সবাই মিলে সোহাগের ওপর চড়াও হয়। এ সময় নাদিমের কাছে থাকা ধারালো ছোরা নিয়ে ‘কাটার রাসেল’ সোহাগের পেটে উপর্যুপরি আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই বাদী হয়ে উত্তরখান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় গত সোমবার রাতে দক্ষিণখান থানাধীন মোল্লারটেক থেকে রাসেল ওরফে কাটার রাসেল ও মো. হৃদয়কে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও হত্যার কথা স্বীকার করেছে তারা।
এর আগে গত ১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাঠানটুলী এলাকায় আহাদ আলম শুভ মিয়া নামের এক যুবককে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে একটি কিশোর গ্যাং’র সদস্যরা। নিহত শুভ পাঠানটুলীর মো. বশির মিয়ার ছেলে। এলাকার এক যুবককে চড়-থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতেই শুভকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও শুভ’র স্বজনরা।
এছাড়া গত ৪ আগস্ট ফতুল্লার গাবতলীতে ওয়াসিফ গাউসিল উৎস নামের এক কিশোর রামদা হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে। এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজে এ ঘটনা ধরা পড়ে। ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, উৎস বড় একটি ছোরা নিয়ে একটি গলি থেকে উত্তেজিত অবস্থায় বের হয়ে আসে। কয়েকজন অনুসারী নিয়ে কয়েক মিনিট পর সে আবারো সেই গলিতে ঢুকে। ওই ঘটনার পর স্থানীয় নিজামের মা নূরজাহান বেগম ফতুল্লা মডেল থানায় অভিযোগ দেন। তিনি অভিযোগ করেন, উৎস ১০ থেকে ১৫ জন নিয়ে হত্যার উদ্দেশে ৪ আগস্ট নিজামকে ধাওয়া করে। এ সময়ে প্রতিপক্ষের কাছে দেশীয় অস্ত্র ছিল।
এছাড়াও গত ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাং’র দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় বন্দরের কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মিহাদ (১৮) ও বন্দরের বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জিসান (১৫)। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই দুই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে গত ১ এপ্রিল ফতুল্লার দেওভোগ আদর্শনগর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা শরি হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত শরিফের বাবা আলাল মাতব্বর জানান, কিশোর গ্যাং’র সদস্য শাকিল ও লালনসহ কয়েকজন শত্রুতার জেরে তার একমাত্র ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
গত ৬ মাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১০ জনের বেশি গ্যাং দলের সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি হত্যার ধরন একই রকমের। এসব ঘটনায় ৬ কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছেন পুলিশ। তবে এ ধরনের কতগুলো গ্যাং রয়েছে, কিংবা সদস্য সংখ্যা কত? তার কোনও হিসেব নেই পুলিশের খাতায়।
এলাকাভিত্তিক গ্যাং কালচারের অন্যতম স্টাইল হচ্ছে দল বেঁধে মোটরসাইকেল মহড়া। করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে কিছুদিন এই কালচার বন্ধ থাকলেও ফের তাদের তৎপরতা আগের মতোই দৃশ্যমান। এদের মুখে মাস্ক পড়ার বালাই নেই। মাথায় হেলমেট ছাড়াই এক মোটরসাইকেলে ৩ জন উঠে ৮/১০টি মোটরসাইকেল নিয়ে তীব্র শব্দে এরা দাপিয়ে বেড়ায় নিজ নিজ এলাকার অলি-গলি। নতুন কোনো গ্যাং যেন ওই এলাকায় মাথা তুলতে না পারে, এ যেন তারই মহড়া।
রাজধানীর খিলগাঁও, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, উত্তরা, টঙ্গি, ফার্মগেট, রাজাবাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোরদের গ্যাং কালচার রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রাজধানীতে এফএইচবি, নিউ নাইন স্টার, বিগ বস, ম্যাড বয়েজ, ডিসকোসহ অন্তত ৩২টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। তাদের সদস্যদের পরিচয়ের জন্য রয়েছে নিজস্ব ‘কোড’। একেক কোড’র আওতায় ভাগ করে দেয়া হয়েছে একেকটি এলাকা। আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ ঘটনায় নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এদিকে, গত ৬ মাসে কিশোর গ্যাং এর ১০ সদস্য হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১১০ জন। এর মধ্যে হাতিরঝিলে ৮৩ জন, গাজীপুরে ভাই-ব্রাদার নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, বিভিন্নস্থানে এ ধরণের কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় একই রকম কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে এই অপরাধ দমনে পুলিশ চেষ্টা করছে। কিন্তু কেবলমাত্র আইন প্রয়োগ করে এই সমাধান সহজ নয় বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের বিষয়াদি জড়িত রয়েছে। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা উচিৎ।
Leave a Reply